মোমেন থেকে ময়মনসিংহ আর বাইগনবাড়ি থেকে নাসিরাবাদ শহরের উৎপত্তি

ছবি: লেখক কর্তৃক সংগৃহীত গ্রাফিক
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ময়মনসিংহের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য দেখা যায়। আর রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, আড়াইশ' বছর আগে মোমেনসিং এবং আলাপসিং পরগনার সীমানা ঘেঁষে সাগরের মতো ব্রহ্মপুত্র নদের অথৈ পানি ঢেউ খেলত এপার থেকে ওপারে। তখন এই নদীর প্রশস্ততা ছিল পনের-বিশ কিলোমিটার। সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করতে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা সময় লাগত। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা শহর, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও এর সংলগ্ন এলাকা, অফিস-আদালত, বিভাগীয় অফিস, সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়, অন্যান্য উপজেলা-সদর, ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা উপজেলাসহ আলাপসিং পরগনার অধীন ছিল।
ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে উত্তর-পূর্ব ময়মনসিংহ অর্থাৎ ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আংশিক, গৌরীপুর, তারাকান্দা, নেত্রকোনাসহ বিশাল অঞ্চল নিয়ে মোমেনসিং পরগনা গঠিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে পরগনার নামকরনের সময়ে আলাপশাহ ও মোমেনশাহ নামের সাথে কেন ’সিং’ যুক্ত করা হয়েছিল তা সঠিক ইতিহাস খুজেঁ পাওয়া যায়নি। জনশ্রুতি আছে, ’সিং’ এখানে নেতৃত্বের খেতাব বা উপাধি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়াও ’সিং’ এখানে সিংহাসন ও রাজ্য হিসেবেও গণ্য হতো। এ খেতাব যাকে দেওয়া হতো তাকে রাজা অথবা প্রধান সর্দার বা সেনাপতি হিসেবে বিবেচিত হতেন। যেমন সিংনছরত (একটি পরগনার নাম) যার অর্থ রাজা নছরত , সিংধা মৈন ( একটি পরগনার নাম) যার অর্থ ধামৈন এর রাজ্য।
”হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং-এই তিনে মৈমনসিং”, ময়মনসিংহ সম্বন্ধে এ প্রবাদ বহুকাল থেকে প্রচলিত। ভৌগোলিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বহুকাল থেকে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা দুই ভাগে বিভক্ত। তৎকালীন বিশাল ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরে পূর্ব ময়মনসিংহ আর পশ্চিম তীরে পশ্চিম ময়মনসিংহ। সমগ্র ময়মনসিংহ একসময় আসামের কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পশ্চিম ময়মনসিংহের তুলনায় পূর্ব ময়মনসিংহে হাওর, জঙ্গল, অনেক ছোট ছোট ভূখণ্ড (যেমন ভূখণ্ড হিসেবে কান্দা, কান্দি, আটি, হাটি নামে অনেক গ্রাম পরিচিত ), ছোট বড় অনেক খরস্রোতা নদী, জলাশয় ছিল। তখনকার সময়ে নৌকা ছিল একমাত্র প্রধান বাহন। মাঠে ঘাটে পালিত মহিষ এবং অরণ্যে ছিল বহু বন্য মহিষ। তৎকালের পল্লীকবির রচনায় ’মইষাল বন্ধু’ এর মাধ্যমে এ ধরণের চিত্র উপলব্ধি করা যায়। পূর্ব ময়মনসিংহের অরণ্য ভূমিতে কামরূপদের কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য উদ্ভব হয়। এ ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি অসভ্য কোচ, মেচ, হাজং, গারো, ভূটিয়া জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হতো। তারা ছিলো যুদ্ধবাজ, দলবদ্ধ হয়ে বন্য পশু শিকার করতো। সম্ভবতঃ মহিষের শিং দিয়ে বিভিন্ন অস্ত্র, রণসিঙ্গা, রাজ্যের প্রতীক, উপাধি, বাহুবলির খেতাব, সিংহাসন, মুুকুট ইত্যাদি তৈরি করা হতো। মহিষের শিং দিয়ে তৈরি রণসিঙ্গা বাজিয়ে, ঢাক ডোল বাজিয়ে পশু শিকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুদ্ধ বা খেলা পরিচালনা করা হতো। রাজ্যের অধিশ্বরের ঈশারায় সিঙ্গা বাজিয়ে চলতো রাজ্যের কার্যক্রম।
১৪৯৮ খ্রীষ্টাব্দে হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি আসাম রাজ্যে প্রবেশ করে, কামরূপ রাজ্য জয় করে, ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব দিক জয় করে ত্রিপুরা পর্যন্ত অধিকার করেন। মুসলিম শাসকরা তাদের রাজ্য পরিচালনা, অন্যান্য সুবিধা ও ভাষাগত সুবিধার জন্য স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চ্চা অব্যাহত রেখেছেন। এখনও নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মহিষের শিং দিয়ে তৈরি সিঙ্গা বাজানো দেখা যায়। তা ছাড়াও ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে সিঙ্গা, বাঁশি, ঢাক, ডোল বাজিয়ে লাঠিয়াল বাহিনীর মহরা দেখা যায়। তাই ”হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং” এখানে ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা লুকিয়ে আছে।
প্রাচীনকালে নছরতশাহী বা নছরতবাদ বা নাসিরাবাদ নামে বৃহৎ প্রদেশঃ
সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ-এর জ্যেষ্ঠপুত্র নুসরত শাহ পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৫১৯ খিস্টাব্দে ‘সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পিতার সাথে তৎকালীন ময়মনসিংহের বৃহৎ কামরূপ অঞ্চল জয় করে, সেখানে থাকা অবস্থায় নছরতশাহী বা নছরতবাদ বা নাসিরাবাদ নামে নতুন বৃহৎ প্রদেশ পত্তন করেন। লেখক শ্রীকেদারনাথ মজুমদারের ’ময়মনসিংহের ইতিহাস’ নামক প্রামণ্য গ্রন্থে নছরৎসাহ বা নছরৎসাহি সমন্ধে বর্ণনা করেছেন।
কেদারনাথ মজুমদারের মতে, নছরতের নতুন শাসিত প্রদেশ ”নছরত ও জিয়াল” নামে পরিচিত হয়। কামরূপ কর্তৃক পলায়িত নছরৎসাহ আশ্রয়স্থলকে ”নছরত ও জিয়াল” নামাকরণে অভিহিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার শাসনকালে সমগ্র প্রদেশকে ”নছরৎসাহি” নামেও অভিহিত করেছিলেন। বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এই নছরৎসাহির নামান্তর বা নামকরণ। এই নছরৎসাহি সম্রাট আকবরের সময়ে ’সরকার বাজুহা’ ও ইংরেজ শাসন সময়ে ময়মনসিংহ জেলা হিসেবে পরিচিত হয়। বস্তুতঃ হুসেন শাহের রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং এগুলোর শাসনভার দেওয়া হয়েছিল গভর্নরের ওপর। ঘোড়াঘাট, বারবকাবাদ, বাজুহা, সিলেট, সোনারগাঁও প্রভৃতি প্রদেশ গঙ্গা (পদ্মা) নদীর উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। সমস্ত প্রশাসনিক অঞ্চল বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। কখনো আরসা, যেমন আরসা সাতগাঁও, আবার কখনো ইকলিম, যেমন ‘ইকলিম মুয়াজ্জামাবাদ’। সুলতান সরাসরি প্রাদেশিক গভর্ণর নিযুক্ত করতেন। একটি প্রদেশ আবার কয়েকটি জেলা বা মহলে বা শহরে বিভক্ত হতো এবং একজন শাসনকর্তার ওপর সামরিক কর্তব্য অর্পিত হতো। মহলের প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হতো শিকদার অথবা ‘জঙ্গদার’।
তবে এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল যে, বাংলার অন্যান্য সুলতানদের মতো হুসেন শাহের প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তার শাসনকালের বেশ কিছুসংখ্যক লিপি পাওয়া গিয়েছিল। পূর্ব ময়মনসিংহে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কেন্দুয়া এবং তাড়াইল উপজেলা নাসিরুজ্জিয়াল পরগনাভূক্ত ছিল। ঐতিহাসিকের মতে, নছরত শাহ্ আসামের কামরূপ থেকে পালিয়ে পূর্ব ময়মনসিংহের (বর্তমান নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায়) রোয়াইলবাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। পরবর্তীকালে ময়মনসিংহের সমস্ত অঞ্চল সমন্বয়ে যুবরাজ নসরত শাহের নামানুসারে নসিরুজিয়াল পরগনা বা প্রদেশ গঠিত হয়। নাসিরুজিয়াল পরগনার এক কালের সদর দপ্তর তাড়াইল অথবা কেন্দুয়ায় অবস্থিত ছিল।
শ্রী কেদারনাথ মজুমদারের মতে, আসামের পাহাড়ি অঞ্চলের কামরূপ হতে নছরৎ পলায়ন করে মুয়াজ্জমাবাদ (বর্তমান পূর্ব ময়মনসিংহে) আগমন করেন ও পূর্ব ময়মনসিংহের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার অধিকৃত কামরূপের অংশ দিয়ে নছরতের নতুন শাসিত প্রদেশ “নছরত ও জিয়াল” নামে পরিচিত লাভ করে।
এখানে প্রশ্ন আসে, তাহলে সুলতান আমলে পূর্ব ময়মনসিংহে সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ নাসিরাবাদ বা নাসিরুজিয়াল প্রদেশ গুড়াপত্তন করেন আর ইংরেজ শাসনামলে অর্থাৎ ১৭৯১ ইং সালে পশ্চিম ময়মনসিংহে নাসিরাবাদ শহর গুড়াপত্তন করেন কে? নাসিরাবাদের ঐতিহাসিক বর্ণনায় তা বিভিন্ন ভাবে পাওয়া যায়।
সুলতান আমলের ’নছরতবাদ’ থেকে ’সরকার বাজুহা’ নামকরণঃ
মুঘল আমলে সুবা বাংলাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৯টি সরকারে এবং ৬৮২টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল। সেই সরকারগুলির মধ্যে ‘সরকার বাজুহা’ আকার আয়তনে ছিল অনেক বড়। তৎকালে সরকার বাজুহাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৩২টি মহলে বিভক্ত করে। সে সময় সরকার বাজুহার মোট রাজস্ব ছিল ৯৮ লাখ ৭ হাজার ৯২১ টাকা। সিরাজগঞ্জ জেলাটি সেই সরকার বাজুহার ৩২টি মহলের মধ্যে একটি। ‘‘সরকার বাজুহার’’ মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত মোমেনশাহী, ভাওয়াল বাজু ও ঢাকা বাজু উল্লেখ আছে। ঢাকার কিছু এলাকা এবং ভাওয়ালগড়সহ বৃহত্তর মোমেনশাহী জেলার সমগ্র এলাকাই ছিল সরকার বাজুহার অন্তর্গত।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৮৪৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ ছিল মোমেনশাহী জেলার অন্তর্গত। বলা হয়, সুলতান হোসেন শাহের সময়ে অঞ্চলটি “নছরত শাহী” প্রদেশ নামে পরিচিত ছিল, মুঘল সম্রাট আকবরের রাজ সচিব টোডরমল্লের বন্দোবস্তে তারই নাম ‘সরকার বাজুহা’। উক্ত ‘সরকার বাজুহা’ এর আয়তন ছিল পূর্বসীমা বর্তমানের বৃহত্তর সিলেট জেলার কিছু অংশ, পশ্চিমে বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ এবং দক্ষিণে বর্তমান ঢাকা শহরের দক্ষিন, বুড়িগঙ্গার তীর পর্যন্ত। ইংরেজ আমলেই ‘সরকার বাজুহা’ হলো বিশাল ময়মনসিংহ জেলা।
পূর্ব ময়মনসিংহ মুঘল, সুলতান ও বারভূঁইয়াদের স্মৃতিচিহ্নের স্থানঃ
পূর্ব ময়মনসিংহের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুঘল ও সুলতান আমলের পাঁচটি সামরিক দুর্গ বা কেল্লা পর্ব ময়মনসিংহে অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় দুটি সামরিক দুর্গ- কেল্লা বোকাইনগর ও কেল্লা তাঁজপুর; নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায় রোয়াইলবাড়ি; কিশোরগঞ্জ জেলায় জঙ্গলবাড়ি (করিমগঞ্জ) ও এগরসিন্দুর। বস্তুতঃ মোমেনসিং পরগনার ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বর্ণখনি গৌরীপুর উপজেলা। সুলতান ও মুঘল আমলের মসজিদ, মন্দির, টাকশাল, বারভূঁইয়া এবং মুঘল আমলের দেওয়ান বাড়ি, সর্দার বাড়ি, নবাব আমলের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের বাড়ি, মধ্যযুগের অজানা কিছু মাজার, প্রাচীন নির্দশন এ উপজেলায়। গৌরীপুর উপজেলার অস্থিত্ব নয়টি এস্টেটের বারটি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।
কেদারনাথ মজুমদারের মতে, প্রাচীন জমিদার ও জমিদারী শাসনকালে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে শাহ সুজা রীতিমতো বাংলার কর আদায় করতে আরম্ভ করেন। কাননগো কার্যালয় : রাজস্ব ও জমা-জমির বন্দোবস্তের জন্য স্থানে স্থানে কাননগুর কার্যালয় স্থাপিত ছিল। দশকাহনীয়ার (শেরপুর) অন্তর্গত দর্শা, মমিনসাহির (ময়মনসিংহ) অন্তর্গত বোকাইনগর (গৌরীপুর) ও বড়বাজুর অন্তর্গত নালিপা নামক স্থানে তিনটি প্রধান কাননগো কার্যালয স্থাপিত হয়েছিল। অন্যান্য বিচার আচার পরগণার চৌধুরী (জমিদার) দিগের দ্বারাই সম্পাদিত হতো। এই পরগনা অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বড় এবং একটি বৃহৎ জলদুর্গ ও দুটি প্রাসাদ দুর্গ থাকায় সামরিক ঘাটির জন্য বিখ্যাত ছিল। পূর্ব ময়মনসিংহের বিভিন্ন সময়ের ইতিহাসের কথা উঠে এসেছে। যেমন কামরূপ হতে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ-এর জ্যেষ্ঠপুত্র নুসরত শাহ পলায়ন করে মুয়াজ্জমাবাদ (বর্তমান পূর্ব ময়মনসিংহে) আগমন করেন ও পূর্ব ময়মনসিংহের শাসনভার গ্রহণ করেন। এমনি করে মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁর কথা জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি এক প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তার মূল বাড়ি বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সোনাগাঁওয়ে। কিন্তু সেটি ছাড়াও তার আরো একটি বাংলো বাড়ি ও ঘাঁটি ছিল কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িতে। এটা বীর ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রচলিত। তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায় ভাটি এলাকার বৃহত্তর ঢাকার ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্ব অংশ নিয়ে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর, বারভূঁইয়ার নবাব সমতুল্য জমিদার, মুঘল আমলের ইতিহাসখ্যাত তিনটি বইয়ের উল্লেখিত বীরযোদ্ধা আফগান হিরো খাজা উসমান খাঁ উত্তর উরিষ্যা থেকে বোকাইনগরে আসেন।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনা (উত্তর-পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা) ও জফরশাহীর পরগনা (জামালপুর) এই দুই পরগনার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর দুই পুত্র দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ছেলেকে। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। সে সময়ের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোরের উদ্যোগে মোমেনসিং পরগনা থেকে ‘সরকার বাজুহার’ পরিবর্তে ময়মনসিংহের নামকরণ করা হয়।
রেনেলের মানচিত্রে আলাপসিং ও মোমেনসিং পরগনায় অংকিত অতি প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ:
জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্র বাংলার প্রাচীন মানচিত্র। মানচিত্রগুলো ছিলো একসময় দুষ্প্রাপ্য। দেখা যাচ্ছে, প্রথম বাংলার মানচিত্র আঁকেন মেজর জেমস রেনেল। তিনি একজন ব্রিটিশ ভূবিদ, ভূগোলবিদ, নৌ-প্রকৌশলী, ঐতিহাসিক এবং মহাসমুদ্রবিদ্যার জনক। রেনেলের দেখা আলাপসিং ও মোমেনসিং পরগনা এখন বদলে গেছে ৯৫ ভাগ। ১৭৬৪ সালের শুরুর দিকে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জরিপ কাজ সম্পন্ন করে মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। এই জেমস রেনেলই তো ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করতে গিয়ে তাদের হাতে বেদম মার খেয়েছিলেন। তখনও কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্র একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। উল্লেখ্য যে, ১৭৬৪ সাল থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত এই তের বছর তিনি বঙ্গদেশের ব্রিটিশ জরিপকাজে নিযুক্ত ছিলেন। তার তৈরি মানচিত্র পরবর্তীতে প্রায় নির্ভুল প্রমাণিত হয়। তার কয়েকটি মানচিত্র সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেই বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার নতুন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্য সব প্রাচীন নৌবন্দরের মতো বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার অনেক স্থানের নামই তার মানচিত্রে দেখতে পাওযা যায় এবং রেনেলের সব মানচিত্রগুলো দেখলে ও গবেষণা করলেই তা ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস সহজে বোঝা যাবে।
এখানে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে স্থানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। তবে বলে রাখা ভাল, উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে স্থানগুলোর নাম রেনেলের মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিক টানের কারণেও নামের বিকৃতি ঘটতে পারে। এমনও হতে পারে, রেনেলের মানচিত্রে পুরাতন স্থানগুলোর যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হয়েছে। এমনি করে বর্তমান নামের সঙ্গে কিছুটা অমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন বাইগনবাড়ি থেকে বেগুনবাড়ি। তবে যে কারণেই স্থানের নামগুলোর মধ্যে গড়মিল পরিলক্ষিত হোক না কেন, রেনেলের মানচিত্রে নির্দেশিত বর্ণনা এবং জায়গাগুলোর বর্তমান অবস্থান হুবহু মিলে যায়।
আর একটি কথা বলে নেয়া ভাল, রেনেলের এ মানচিত্র সহজেই অনুমান করা যায় যে, অংকিত জায়গাগুলো প্রাচীন জনপদ হিসেবে বর্তমান ময়মনসিংহ অঞ্চলের ইতিহাসকে দিনে দিনে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়েছে বহুগুণ। এসব প্রাচীন জায়গাগুলো আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। স্থানীয় হিস্টোরিক্যাল সোস্যাইটির মাধ্যমে রেনেলের মানচিত্রে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার যেসব স্থানের নাম উল্লেখ আছে তার বিবরণ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।
আলাপসিং পরগনায় রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী তৎকালীন নাসিরাবাদ শহরের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি তবে বাইগনবাড়ি নামে পুরাতন শহরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ রাস্তার সংযোগস্থল, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে বাইগনবাড়ি নদীর সংযোগস্থল, ঐতিহাসিক স্থান, বানিজ্য কেন্দ্র, নৌবন্দর হিসেবে এক সময়ে প্রসিদ্ধ ছিল। যদ্দুর মনে হয়, নাসিরাবাদ শহরের পূর্ব নাম বাইগনবাড়ি। উল্লেখ্য যে, আমেরিকায় অবস্থিত নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোস্যাইটি মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে রয়েছে বিশ্বের মূল্যবান সব ডকুমেন্ট। তন্মধ্যে একটি ডকুমেন্ট ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ’এ ডিসক্রিপশন অব দি রোডস ইন বেঙ্গল অ্যান্ড বাহার A Description Of The Roads In Bengal And Bahar’ নামে একটি বিখ্যাত বই যা সমগ্র বাংলা ও বিহারের রোড ম্যাপ ও নদী পথের দূরত্বের তালিকা রয়েছে। রেনেলের কয়েকটি মানচিত্রের মধ্যে একটি রোডম্যাপ A General Map of the Roads in Bengal And Bahar এই প্রাচীন বইটিতে রয়েছে যার মাধ্যমে ময়মনসিংহের গুরুত্বপূর্ন স্থানের প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে।
সংগৃহীত রেনেলের রোড ম্যাপটি ময়মনসিংহের ’ পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। রেনেলের অংকিত রোডম্যাপে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হচ্ছে-বাইগনবাড়ি (বেগুনবাড়ি), গোলাবাড়ি, বোকাইনগর, সেরপুর-১ (শেরপুর উপজেলা, বগুড়া), সেরপুর-২ (শেরপুর জেলা), সুসং, জঙ্গলবাড়ি, আজমেরী, সিলেট, সুজতপুর, দেওয়ানগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, হোসনেবাদ, মধুপুর, আতিয়া, ভাওয়াল ইত্যাদি। এমনকি যে শহর নিয়ে এতো আলোচনা, সেই নাসিরাবাদ শহর নামেও কোনো স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। তাছাড়া রেনেলের অংকিত আরেকটি পরগনাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, পশ্চিম ময়মনসিংহের পরগনা ও প্রসিদ্ধ স্থানগুলো - আলাপসিং পরগনা, পুকুরিয়া পরগনা, কাগমারী পরগনা, জফরশাহী পরগনা, আতিয়া পরগনা, ভাওয়াল পরগনা ইত্যাদি; এখানে প্রাচীন শহর বাইগনবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, এখানে প্রাচীন জনপদ, শেওড়া, মুক্তাগাছী, মধুপুর, রামচনপুর, কালীগঞ্জ, মালাঞ্চ, শ্যামগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, নারায়ণপুর, মির্জাপুর, কাঞ্চনপুর ইত্যাদি।
পূর্ব ময়মনসিংহের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনা নিয়ে এত আলোচনা, সেই মোমেনসিং নামেও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আংশিক অংশ, গৌরীপুর, তারাকান্দা, নেত্রকোনাসহ বিশাল অঞ্চল নিয়ে মোমেনসিং পরগনার পরিচয় পাওয়া যায়। মোমেনসিং পরগনার দক্ষিণে হোসেনশাহী পরগনা, উত্তরে সুসং, দশকাহনিয়া, শেরপুর পরগনা ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে প্রাচীন শহর বোকাইনগর, জঙ্গলবাড়ি, শিমুলকান্দি, রামপুর, দুর্গাপুর ইত্যাদি; এখানে প্রাচীন জনপদ, নৌবন্দর বা প্রসিদ্ধ স্থানের নাম সরিষাহাটি, পরানগঞ্জ, কাশেরগঞ্জ, মুদ্দেরগঞ্জ, রাঘবপুর, মধুপুর, হুগলা, তেলিগাতি, সোনাজুরি, মদন, খালিয়াজুরি, কান্দিউড়া, ইটনা, নিকলি, এগারসিন্দুর, মহিষপাড়া, বাজিতপুর, মিটামইন, সিংপুর, বাঁশাটি, পেচাংগিয়া, রঘুনাথপুর, মধ্যনগর, বাইগনবাড়ি কুঠি, রাজাগঞ্জ, নাটেরকোনা ইত্যাদি নিয়ে অনেক গবেষণা আছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে পূর্ব ময়মনসিংহের মোমেনসিং পরগনাটি ধীরে ধীরে জেলা বা প্রদেশের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সুতরাং রেনেলের মানচিত্র অথবা ইতিহাস থেকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, যে মোমেনসিং পরগনার নামের সঙ্গে ইংরেজদের পেশা-পদবীর সাথে ’মোমেনসিং’ নামটি মিল থাকায় বুঝা যায় মোমেনসিং পরগনা থেকে ’ময়মনসিংহ’ নামের সৃষ্টি। ১৭৯১ ইং সালে নাসিরাবাদ জেলা হিসেবে নয়, নগর হিসেবে পত্তন হয়েছিল তবে মোমেনসিং জেলার প্রধান শহর নাসিরাবাদ ১৯০৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
১৯৩১ ইং সালে প্রকাশিত অবিভক্ত বাংলার মানচিত্রে তাকালে দেখা যায়, একটি ছিল অঞ্চলভিত্তিক ময়মনসিংহ আর অন্যটি ছিল শহরভিত্তিক ময়মনসিংহ ও বন্ধনীতে নাসিরাবাদ লেখা আছে।
পরগনা ভিত্তিক, তরফ ভিত্তিক, এস্টেট ভিত্তিক, হিস্যা ভিত্তিক জমিদারি:
সুলতানী আমলেই পরগনা সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনামলে এই প্রশাসনিক এলাকা তৈরি করা হয়েছিল প্রশাসনিক কাজ এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে। তাছাড়া, রাজস্ব আদায়ের জন্য মৌজা সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানদের শাসনামলে। তবে পরগনা ছিলো মৌজার চেয়ে অনেক বড় রাজস্ব এলাকা। ১৭৭৯ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে মোমেনসিং নামটি বর্তমান 'ময়মনসিংহ' অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। মোমেনসিং পরগনায় ছিল পূর্ব ময়মনসিংহের পাঠানদের প্রসিদ্ধ ও অন্যতম সামরিক ঘাটি। সমগ্র পরগনা একটি জলদুর্গ হিসেবে কাজ করতো। এ পরগনায় জালের মতো ছোট বড় অনেক নদ-নদী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তাছাড়া দ্বীপ বা চর, জলাশয় এবং গভীর অরণ্য ছিল। বহিঃশত্রু বা জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন স্থানে সামরিক ফাঁড়ি বা জলদুর্গ নির্মাণ করা হতো। এখানে প্রাসাদ দুর্গ ছিল দুটি- কেল্লা তাজপুর ও কেল্লা বোকাইনগর।
গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী। ঈশা খাঁ সে সময় বোকাইনগরকে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাটি ও দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেন। ঈশা খাঁর রাজ্যে ২২ পরগনাভূক্ত ছিলো। রাজনৈতিক কারণে মোমেনসিং পরগনা কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো। এই পরগনা অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বড় এবং একটি বৃহৎ জলদুর্গ ও দুটি প্রাসাদ দুর্গ থাকায় সামরিক ঘাটির জন্য বিখ্যাত ছিল। পরবর্তীতে ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর, বারভূইয়ার নবাব সমতুল্য জমিদার, মুঘল আমলের ইতিহাসখ্যাত তিনটি বইয়ের উল্লেখিত বীরযোদ্ধা আফগান হিরো খাজা উসমান খাঁ উত্তর উড়িষ্যা থেকে বোকাইনগরে আসেন। তখন জলদুর্গের প্রতিটি ফাঁড়িকে আরও শক্তিশালী করা হয়। ১৬০৯ সালে খাজা উসমান খাঁ বোকাইনগর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই পরগনার সবকিছু মুঘলদের অধীনে চলে যায়।
ইংরেজ শাসনামলের গোড়ার দিকে পরগনা বহাল ছিল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস পরগনা প্রথা বিলোপ করে জমিদারি প্রথা চালু করেন। ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন এলাকাকে জেলায় বিভক্ত করেন। এই সব জেলাগুলো আবার কয়েকটি ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করেন। এগুলোর নাম ছিলো এস্টেট বা তহশিল বা তালুক। কিন্তু ভৌগোলিক বিবরণ, ভূমি জরিপ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তখনো পরগনার হিসাব ছিল। নবাব আমলে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী কর্তৃক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের কাচারি ও প্রধান কাননগো কার্যালয়ের গোড়াপত্তন হয় বোকাইনগরে। যতদূর জানা যায়, গভর্ণর মুর্শিদকুলি খান (পরবর্তীতে বাংলার প্রথম নবাব) এর অধীনে ঢাকা এবং মুর্শিদাবাদে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী সেই সময়ের মোমেনসিং পরগণা এবং নবাব আলীবর্দি খাঁর আমলে জামালপুর জেলা অন্তর্গত জফরশাহী পরগনা বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ও নবাব মুর্শিদকুলী খানের খুবই আস্থাভাজন। যার ফলে পূর্ব ময়মনসিংহের বড় জমিদার হিসেবে তার জীবদ্দশায় জমিদারি করেছিলেন বোকাইনগর বাসাবাড়ি (বাশেঁর বাড়ি) এবং দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট নিকট করৈ রাজবাড়ি থেকেই।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নবাব আমলের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধররা ব্রিটিশ আমল জুড়্ইে তাদের জমিদারি বিদ্যমান ছিল। তাদের ধারাবাহিকতায় পরগনা ভেঙ্গে শুধু গৌরীপুর উপজেলায় ১২টি জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাদের জমিদারের এস্টেটের অনেক পৃথক এলাকা ও সীমানা এমনকি সিলেট এবং জামালপুর পর্যন্ত ছিল। এস্টেটগুলো হচ্ছে- গৌরীপুর এস্টেট, কৃষ্ণপুর এস্টেট, বাসাবাড়ি এস্টেট, রামগোপালপুর এস্টেট, ভবানীপুর এস্টেট, গোলকপুর এস্টেট, ডৌহাখলা এস্টেট, কালীপুর এস্টেট (কালীপুর ছোট তরফ, কালীপুর মধ্যম তরফ, কালীপুর বড় তরফ, কালীপুর ডি.কে.লাহিড়ী জমিদার বাড়ি), ভালুকা এস্টেট।
প্রসঙ্গক্রমে, ২০২০ সালে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপে দেখা যায়, এস্টেটের অধীনে গ্রামগুলি ছিটমহালের মতো এবং তখন গ্রামগুলো দূরদূরান্ত থেকে শাসিত হয়েছিল।
মোমেনসিং পরগনা থেকে সৃষ্টি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নামকরণ:
’মোমেনসিং’ নামে জেলা পত্তনের সময়ে অথবা বাংলার উপ-প্রদেশ হিসেবে ’সরকার বাজুহা’র নাম পরিবর্তন করার সময় রেনেলের মানচিত্রে অংকিত ’মোমেনসিং’ পরগনা ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজকীয় দাপট, ভূমির পরিমাপ, রাজস্ব আদায়ের পরিমাপ ইত্যাদি অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাছাড়া, পশ্চিম ময়মনসিংহের তুলনায় পূর্ব ময়মনসিংহে জমিদারির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। বিভিন্ন রাজদরবারে অর্থাৎ মুঘল দরবারে, নবাব দরবারে এবং ইংরেজ শাসনকালে বিভিন্ন আদালতে মোমেনসিং পরগনার নাম ব্যাপক আলোচিত এবং সুপরিচিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর, বারভূঁইয়ার নবাব সমতুল্য জমিদার, মুঘল আমলের ইতিহাসখ্যাত তিনটি বইয়ের উল্লেখিত বীরযোদ্ধা আফগান হিরো খাজা উসমান খাঁ উত্তর উড়িষ্যা থেকে গৌরীপুরের বোকাইনগরে আসেন। ১৬০৯ সালে খাজা উসমান খাঁ বোকাইনগর ত্যাগ করার পর অত্র পরগনার সব কিছু মুঘলদের অধীনে চলে যায়। এমনি করে, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী মুর্শিদাবাদের দরবারে রাজস্ব বিভাগে প্রধান কর্মচারী ছিলেন এবং ক্রমশ কাননগো পদ লাভ করেন। নবাব দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৭১৭ সালে তিনি সেই সময়ের মোমেনসিং পরগণার বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী কেল্লা বোকাইনগর নিকটে অবস্থিত বাসাবাড়িতে কাচারি ও কাননগো অফিস নির্মাণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদরায় ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁর খুবই আস্থাভাজন ও মোহনলাল এর মত বড় মাপের রাজ কর্মচারী ছিলেন। চাঁদ রায়ের উদ্যোগে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী জামালপুর জেলার অন্তর্গত জফরশাহী পরগনা লাভ করেন। ফলে তিনি দুই পরগনা (মোমেনসিং ও জফরশাহী) মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ একর জমির অধিকারী হয়ে জনসমাজে বিশেষ খ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তখন মুক্তাগাছা জমিদার অধীনে আলাপসিং পরগনার তিন লক্ষ ছাব্বিশ হাজার একর জমি ছিল।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায়ের মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই অবশিষ্ট চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু'টি তরফ গঠিত হয়েছিল- তরফ রায় হিস্যা ও তরফ চৌধুরী হিস্যা। এই দুই পরগনার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর তরফ রায় হিস্যার দুই পুত্র (কৃষ্ণকিশোর ও কৃষ্ণগোপাল) দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজপুত্রকে। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। জামালপুর জেলার অন্তর্গত জফরশাহী পরগানার কৃষ্ণপুর এলাকায় তরফ রায় হিস্যার জমিদার বাড়িতে এবং মালাঞ্চ এলাকায় তরফ চৌধুরী হিস্যার জমিদার বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংধররা বসবাস করতেছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক ও তরফ রায়ের উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পান যুগলকিশোর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে তিনি ছিলেন মহারাজ সমতুল্য জমিদার। ওই সময় মহারাজ সনদ দিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবশ্যই তিনি পদটি পেতেন। সে সময় জফরসাহি অঞ্চলে এক মহামারি দেখা দিলে যুগলকিশোর কৃষ্ণপুর থেকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে আসেন। তখন তাকে মোমেনসিং পরগনার জমিদার বা রাজা বলা হতো। এ দিক থেকে দেখতে গেলে তখন গৌরীপুর, কালীপুর, রামগোপালপুর নামে কোন জমিদারি পত্তন হয়নি।
যুগলকিশোর রায় চৌধুরী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং পরাক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। বিষয়-বুদ্ধি, রাজনীতি, সমরনীতি প্রভৃতিতে তার মত প্রতিভাবান ও তেজস্বী পুরুষ সেইসময়ে অতি নগন্য ছিল। তার প্রতাপে ”বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খাইত”। জনগণ তাকে যমের মতো ভয় করত। তার অঙ্গুলি হেলানে সমগ্র পরগনা চলতো। ফকির সন্ন্যাসি মোমেনসিং পরগনায় ছিল না। তবে সিংধার জমিদার মুহম্মদ খাঁর সাথে তার শত্রুতা ছিল। নবাব আমল থেকে জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধরদের প্রতি তার বিদ্বেষভাব ছিল। ময়মনসিংহে বন্যার পর তার প্রশ্রয়ে তার প্রজারা যুগলকিশোরের এলাকায় লুটপাট চালাতে থাকে। যুগলকিশোর এই লুটতরাজ দমন করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। তিনি মুহাম্মদ খাঁ-কে ব্যবস্থা নিতে বললে তার অনুরোধে কর্ণপাত না করে তিনি অবজ্ঞার সাথে উত্তর পাঠান। যুগলকিশোর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
সালটি ছিল ১৭৭৯। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার লাঠিয়াল সৈন্য নিয়ে সিংধা পরগনায় আক্রমণ করেন। তার পদাতিক দলে লাঠি, বর্শা, সড়কি ও তরবারির আস্ফালন ছিল। তারা প্রতিশোধস্বরূপ সিংধায় প্রবেশ করে নির্বিচারে প্রজাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করে ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তখন ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন কালেক্টর রটন সাহেবের কাছে মুহাম্মদ খাঁ এ বিষয়ে নালিশ জানান। রটন সাহেব তদন্ত করে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠান। তার এ পাশবিক অত্যাচারের জন্য ঢাকার কমিশনার ডব্লিউ ডগলাস ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রেভিনিউ বোর্ডের অনুমতিক্রমে রাজা যুগলকিশোর রায়ের সকল সম্পত্তি বাজোয়াপ্তপূর্বক তাকে ঢাকায় বিচারার্থে প্রেরণের জন্য ময়মনসিংহের কালেক্টরকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু কালেক্টর রটন সাহেব তার পক্ষাবলম্বন করায় তাকে ঢাকার পরিবর্তে ময়মনসিংহেই বিচার করা হয়। তাকে বিচারে জামিন দিয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইংরেজদের সাথে যুগলকিশোরের সুসম্পর্ক থাকায় মোমেনসিং পরগনার নাম দিয়েই মোমেনসিং জেলা সৃষ্টি হয়েছে।
ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং নামটি প্রথমে পরগনা এবং পরে উপ-প্রদেশ ও জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের পেশা-পদবী, চিঠি, তারিখসহ অফিসিয়াল ডকুমেন্ট থেকে ময়মনসিংহের ইতিহাস আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, Board of Revenue Proceedings, 11th-18th April, 1788 : A letter from the Collector of Momensing : In the mean time I do myself, the honour to enclose an account of the Bazar prices of rice during the Pous and Maug Months of the Bengal year 1192, 1193 and 1194 in which it is useless to further remarks---. I am & W Wroughton, Collector--- Momensing The 9th April 1788. ### Magistrate of Momensing, Mr. J. Straccy: 29th January.1802 ইত্যাদি।
ময়মনসিংহ জেলা পত্তনের আরেকটি কারণ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। কেদারনাথ মজুমদারের মতে, ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে একদল সন্ন্যাসী আলাপসিংহ ও জফরসাহি পরগণায় প্রবেশ করে জমিদার ও প্রজার অর্জিত শস্য, ক্ষেত থেকে নিয়ে যায়। এর পর জমিদাররা ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি রেভিনিউ বোর্ডে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি রেভিনিউ বোর্ড হতে ঢাকার প্রধানের (Chief of Dacca) উপর সৈন্য প্রেরণের দায়িত্ব ও সাধ্যানুসারে সাহায্য করে জমিদারদের রক্ষার আদেশ জারি করা হয়। ঢাকার Chief জাফরসাহি পরগনায় সৈন্য প্রেরণ করেন। তখন সৈন্যরা বিপন্ন হয়ে ঢাকা প্রস্থান করেন। সন্ন্যাসীদের উলঙ্গ অত্যাচার খরস্রোতে প্রবাহিত হতে থাকে। মার্চ মাসে সন্ন্যাসীরা মালঞ্চার কাছারি লুণ্ঠন করেন। জমিদাররা পলায়ন করে গৌরীপুর উপজেরা অন্তর্গত বোকাইনগর বাসাবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।দক্ষিণে মধুপুর জঙ্গল ও উত্তরে শেরপুরের বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্যই জামালপুরে একটি শাসনকেন্দ্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্য ইংরেজরা জামালপুর সদরে সেনানিবাস স্থাপন করেন।
শ্রী কেদারনাথ মুজমদার তার ’ময়মনসিংহের বিবরণ' নামক প্রামাণ্য গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ময়মনসিংহের প্রাচীন বিবরণ ও কারণ সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন। কামরূপ রাজ্য হতে স্বাধীন ভূখণ্ড নছরৎ সাহের নামানুসারে অভিহিত হয়। তিনি বলেন- ”টোডরমল্লের বন্দোবস্ত কাগজে নছরৎসাহী “সরকার বাজুহা” নামে লিখিত হইয়াছে। ইংরেজ শাসনকালের প্রারম্ভে সরকার বাজুহা “জেলা মমিনসিংহ” নামে অভিহিত হইয়াছে। “ময়মনসিংহ” নামের কারণ ও ময়মনসিংহ নামটি “মমিনসাহীর” পরিবর্তিত সংস্করণ। কথিত আছে দিল্লিশ্বর আকবরসাহের সময়ে মমিনসাহ নামে কোন ব্যক্তি সরকার বাজুহার একাংশের অধীশ্বর ছিলেন। সেই মনিনসাহ হইতে তদীয় অধিকৃত (পরগনার) মহালের নাম মমিনসাহী (মোমেনসিং পরগনা) হইয়াাছিল। আই-ই-আকবরই গ্রন্থে মমিনসাহী মহালের নাম দেখা যায়। মৈমনসিংহ বা ময়মনসিংহ রাজস্বে (বৃহত্তর) জেলার সর্বপ্রধান পরগণা। পরগণা মমিনসাহী বা মৈমনসিংহের গভর্নমেন্ট রাজস্ব সর্বাপেক্ষা অধিক বলিয়া এই জেলা ময়মনসিংহ” নামে অভিহিত হইয়াছে। এই জেলা স্থাপন সময়ে ইহার আকার বর্তমান আকারের অর্থাৎ বৃহত্তর ময়মনসিংহের দ্বিগুণ ছিল। এই জেলা বর্তমান আয়তনেও ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ জেলা ইয়র্কসায়ারের তুলনা অংশ বৃহত্তর।”
১৭৬৫ সালে দেওয়ানী গ্রহণের ফলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল উপ-প্রদেশ হিসেবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণভুক্ত হয়। বাংলাদেশের প্রশাসনিক তাগিদ পূরণের উদ্দেশ্যে সারা দেশের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ জন জেলা কালেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে নোয়াখালী, রংপুর, ঢাকা ও মোমেনশাহী এই চারটি জেলা কালেক্টরেটের সাহায্যে বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল দেশ শাসন করা হতো। পরবর্তীকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সমস্ত অঞ্চল সমন্বয়ে মোমেনসিং পরগনার নামানুসারে মোমেনসিং (ময়মনসিংহ) জেলা বা প্রদেশ গঠিত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে রাজা যুগলকিশোর রায়ের কথা উল্লেখ করা যায়। তার নেতৃত্বেই পরগনার নাম অনুসারে মোমেনসিং (ময়মনসিং) জেলা স্থাপিত হয়। তৎকালীন রামগোপালপুর জমিদার রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তার তৃতীয় পুত্র লেখক শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ’ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাম্মণ জমিদার’ নামক প্রামণ্য গ্রন্থে জমিদারদের বংশ ও যুগলকিশোরের বিভিন্ন ঘটনার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। যুগলকিশোর রায় এ জেলার একজন প্রধান জমিদার এবং বিশেষ গণনী ব্যক্তি।
আলাপসিং পরগনায় পশ্চিম ময়মনসিংহের প্রাচীন শহর বাইগনবাড়ি (বেগুনবাড়ি):
বাইগনবাড়ি ময়মনসিংহের একটি অন্যতম প্রাচীন নগর। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে বাইগনবাড়ি নদী ও আদি (বিশাল) ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে বাইগনবাড়ি শহর অবিভক্ত বাংলায় বেশ পরিচিত ছিল। একসময় বাইগনবাড়ি পশ্চিম ময়মনসিংহের রাজধানী এবং বোকাইনগর পূর্ব ময়মনসিংহের রাজধানী ছিল। রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি নামে একটি উপ-নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বাইগনবাড়ি নদীর সম্বন্ধে কেউ জানে না। তবে সুতিয়া নদী বেগুনবাড়ির সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলেছে। এ থেকে জানা যায়, বেগুনবাড়ির আদি নাম বাইগনবাড়ি এবং সুতিয়া নদীর আদি নাম বাইগনবাড়ি নদী। তবে বর্তমান বেগুনবাড়ি এলাকাতে রেল স্টেশনের নাম বাইগনবাড়ি রেল স্টেশন হিসেবে এখনও বিদ্যমান।
ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, বাইগনবাড়ি নদীর নাম অনুসারে শহরের নাম হয়েছে বাইগনবাড়ি। এক সময়ে নদীর চরগুলিতে প্রচুর বেগুন চাষ হতো এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বেগুন (বাইগন) রপ্তানি করা হতো। তাই নদীর নাম বাইগনবাড়ি। আবার অন্যান্য গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, কামরূপ শাসন আমলে বাইগনবাড়ি নামকরণ করা হয়েছে। ওই সময়ে প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে জাত, ফলন ও প্রকৃতির নাম অনুসারে শহর, বন্দর, নগর ও রাজ্যের নাম দেওয়া হতো। যেমন জঙ্গলবাড়ি, বাসাবাড়ি (বাশেঁরবাড়ি), বড়ইবাড়ি, কমলাবাড়ি, রাজাবাড়ি, ভূটিয়ারবাড়ি, যাত্রাবাড়ি ইত্যাদি।
শেরপুর জেলার সীমানায় এবং আসাম প্রদেশে রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি কুঠি নামে আরও একটি জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্রের বর্ণনায় বাইগনবাড়ির রোড ম্যাপের কথা উল্লেখ্য আছে। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত বই A Description Of The Roads In Bengal And Bahar Ges A General Map of the Roads in Bengal ,1778 কর্তৃক সংরক্ষিত বইটিতে মানচিত্রসহ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাঁচটি সংযোগস্থল বা বাইগনবাড়ির ৫ রাস্তার মোড় পাওয়া গেছে। পূর্বে এ তথ্যের অভাবে সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেছে এই ইতিহাসের কথা। বাইগনবাড়ির রোডম্যাপ ও ডাটা তথ্য দেখে বোঝা যায় বাইগনবাড়ি অতি প্রাচীন শহর। তাছাড়া জেমস রেনেলের বইয়ের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে, কলকাতা থেকে পরানগঞ্জ পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৮ মাইল এবং বাইগনবাড়ি পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৪ মাইল।
আলাপসিং পরগনায় ইংরেজ আমলে নতুন শহরের পরিকল্পনা এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস:
আলাপসিং পরগনায় নাসিরাবাদ নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ইংরেজ আমলে জেলার নামকরণে নাসিরাবাদ হয়নি। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকে জানা যায যে, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নাসিরাবাদ মোমেনসিং জেলার অন্তর্গত সদর টাউন হিসেবে পত্তন ঘটেছিল এবং টাউনের নাম পরিবর্তন হয়েছিল ১৯০৫ সালে। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল ময়মনসিংহ জেলা শহর। আদিতে ’মোমেনসিং’ জেলা- ' মোমেন' থেকে 'ময়মন' এবং ’সিং’ এর সাথে ’হ’ মিলে বর্তমান বাংলায় উচ্চরণ ’ময়মনসিংহ’ এবং ইংরেজিতে উচ্চরণ ’মাইমেনসিং’।এই সব উদাহরণ থেকে স্পষ্টই উপলদ্ধ হয় যে, ময়মনসিংহ জেলার নাম উচ্চরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইংরেজদের রাজনীতি ও জমিদার শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণিসহ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস।
অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শীর মতে, ময়মনসিংহকে বেসরকারীভাবে ’মোমেনশাহী’ লেখার প্রবণতা দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ প্রবণতার একমাত্র উদ্দেশ্য ময়মনসিংহ জেলার বিকৃতিকে সংশোধন করা। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ জরিপকারী মেজর জেমস রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র অংকন করেছিলেন তাতে বাইগনবাড়ির নামে এক বিখ্যাত শহর ছিল। ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে প্রাচীন বানিজ্য শহর বাইগনবাড়ির ৯০ ভাগ ধ্বংস হওয়ার পর ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার জন্য জরিপ কাজ শুরু করেন। এ জরিপের তথ্য জানতে গিয়ে নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাসের আরেকটি তথ্য কচ্চুয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে বের হলো।
’কচ্চুয়া গোষ্ঠীর উৎস সন্ধান ও ক্রমবিকাশ’ এর তথ্যসূত্র অনুযায়ী আড়াইশ’ বছর আগে ময়মনসিংহ শহরে নাসির উদ্দিন মোড়ল নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। পৈত্রিকসূত্রে তিনি ১০০ একর অধিক জমির তালুকদার ছিলেন। তার ৮০ ভাগ জমি ছিল জঙ্গল এবং ২০ ভাগ ছিল আবাদী জমি ও চর। নাসির উদ্দিনের পিতা লস্কর মাহমুদ খুব সাহসী ও বীর ছিলেন। লস্কর মাহমুদ এক সময়ে জঙ্গলে কয়েক ঘন্টায় বন্য মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ করে মহিষের শিং ভেঙ্গে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাকে দেখার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে অনেক লোক এসেছিল। লস্কর মাহমুদের ছেলে নাসির উদ্দিন তার বিশাল জমি দেখে ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার পরিকল্পনা করেন। জরিপে দেখেন, বন-জঙ্গল থাকার কারণে জায়গাটা খুব উচু, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় খুবই উপযোগী। এখানে শহর তৈরি করলে টেকসই হবে। ইংরেজদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেগুনবাড়ির কালেক্টর অফিসে নাসির উদ্দিন মোড়লকে ডাকা হয়। নতুন শহর তৈরি করার জন্য নাসির উদ্দিনের সমস্ত সম্পত্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রয় করতে চায় এবং বিনিময়ে তাকে দ্বিগুন অর্থসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। প্রথম প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশীর চাপ এবং পূর্ব পুরুষদের ভিটা, জমি ও কবরস্থান দেখিয়ে বিক্রি করার অস্বীকার জানান তিনি। এ বিষয় জানার পর ইংরেজরা খুব আশ্চর্যবোধ করেন। পরে বানিয়াদের সহযোগিতা নিয়ে ইংরেজরা শহরের নাম নাসিরাবাদ নামকরণ করে নাসির উদ্দিনের সমস্ত জমি ক্রয় করেন।
প্রচুর অর্থ পেয়ে নাসির উদ্দিন চারটি বিয়ে করে ১৮ জন স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম দিয়ে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন শুরু করেন। ৩০ বছর পর নতুন শহরে নাসির উদ্দিনের ছেলেদের গুন্ডামি শুরু হয়। আদিপত্য বিস্তারের জন্য কোথাও মারামারি, এমনকি খুনও হয়। তাদের তান্ডবে নাসিরাবাদ শহর কম্পিত শুরু হল।এলাকার জমিদাররা নাসির উদ্দিনের তেজস্বী ছেলেদের বিরুদ্ধে কাহিনী বিবৃত করে অভিযোগ করেন। ইংরেজ প্রশাসন তদন্তের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। আদালতের সম্মুখে নাসির উদ্দিনের নাতিসহ ৬০ এর অধিক জনসংখ্যার বিস্তার এবং আত্মীয় স্বজনসহ ১০০ জনের অধিক উপস্থিতি দেখে ইংরেজরা বিচলিত হয়েছিলেন। তখন থেকে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর নামকরণ হয়।
নাসির উদ্দিন মোড়লের বংশ বিস্তার এবং জমিদারদের সঙ্গে গোলযোগের আশঙ্কা দেখে তার তেজস্বী ছেলেদের ’মাইগ্রেট’ বা শহর থেকে তাড়ানোর জন্য ইংরেজরা একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজদের কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ ও তাদের সম্পতির ভাগাভাগির অর্থ নিয়ে আসাম, সিলেট, চট্টগ্রাম, হালুয়াঘাট, তারাকান্দা (ধনিয়া কান্দা), গৌরীপুর, ঈশরগঞ্জ, ত্রিশাল (কানুর বাজার), ময়মনসিংহ সদরের ঘাগড়া ইউনিয়ন (পারুইল বাজার), চর নিনুক্ষীয়া ইউনিয়ন, বলাশপুর, দীঘারকান্দা, ফকিরাকান্দা, পালাকান্দি, শেওড়া, কৃষ্টপুর, পূরবী সিনেমা হল সংলগ্ন চামড়া গুদাম, আকুয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় নাসির উদ্দিনের ছেলে সন্তানরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমান কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৫ হাজার অধিক।
কেবল কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা তাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাসের কথা জনশ্রুতির মাধ্যমে বহুদিন ধরে লালিত করে আসছেন। নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহত করার জন্য এবং কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা সুসংহত করার জন্য ময়মনসিংহের দিঘারকান্দায় একটি সংগঠন গড়ে উঠে। সংগঠনটির নাম ’কচ্চুয়া গোষ্ঠী জনকল্যাণ সংস্থা’। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, 'নাসিরাবাদ একটি অতীত ইতিহাস বিজড়িত শহর ছিল। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এ পর্যন্ত নাসির উদ্দিন মোড়লের কথা আলোচনা আসেনি। এর পেছনে জমিদার আমলের সন্ধানী লেখকদের উন্নসিকতা ও তাচ্ছিল্যবোধ কাজ করেছে। তাছাড়া ইতিহাস বিকৃতি ও নামকরণ পরিবর্তন করার পেছনে জমিদাররা দায়ী। ইংরেজ শাসনামলে ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ'র নামে এখানে শহর তৈরী করা হয়েছিল তা প্রশ্নই আসে না। তা সম্ভব ছিল মুঘল বা নবাব আমলে। সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করার জন্য বর্তমান লেখকদের প্রতি আহ্বান রইল। অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স।'
নাসির উদ্দিনের ইতিহাস এখানে থেমে গিয়েছিল। ছিল শুধু ধূসর স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখছে শুধু কচ্চুয়া গোষ্ঠী। বর্তমান সহযোগিতা করেছে ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠনগুলো।
ময়মনসিংহের সাাম্প্রতিক ইতিহাস:
সরকারি তথ্য বা উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বর্তমান নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস হচ্ছে- মোগল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তার নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ'র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন হয়ে ময়মনসিংহ হয় একটি ভুলের কারণে। বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল বর্জনলাল এন্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এই মাল চলে যায় রাজপুতনার নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু বিভ্রান্তি ঘটায় রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখা হয়। সেই থেকে নাসিরাবাদের পরিবর্তে ময়মনসিংহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে বর্তমানে ইতিহাসের এই কথাগুলো দিয়ে পাঠক-পাঠিকার কাছে অন্ধকারে ঢিল মেরে অথবা গোঁজামিল দিয়ে ইতিহাস বোঝানো হয়েছে। কেননা এখানে ইতিহাসের কোন ধারাবাহিকতা নেই।
ময়মনসিংহের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হচ্ছে ১) কামরূপ রাজ্য হতে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং বিভিন্ন মহালে নামকরণ ২) নছরতের নতুন শাসিত প্রদেশ ”নছরত ও জিয়াল” বা নাসিরাবাদ ৩) নাসিরাবাদ পরিবর্তে ৩২টি মহাল নিয়ে ‘‘সরকার বাজুহা’’ গঠন ৪) সরকার বাজুহা এর পরিবর্তে বৃহত্তর মোমেনসিং বা মোমেনশাহী জেলা বা প্রদেশ পত্তন ৫) মোমেনসিং জেলার প্রধান নগর ’বাইগনবাড়ি’ ধ্বংস হওয়ার পর নতুন প্রধান জেলা শহর ’নাসিরাবাদ’ পত্তন ৬) ’নাসিরাবাদ’ এর পরিবর্তে জেলা শহর হিসেবে বহত্তর জেলা নামানুসারেই আজকের ’ময়মনসিংহ’ সদর এবং সিটি কর্পোরেশন।
”মুঘল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন” এই সাধকের সমাধির অস্থিত্ব বা ইতিহাস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মুঘল আমলে ৩২টি মহাল নিয়ে ‘‘সরকার বাজুহা’’ গঠন করা হয়েছিল এবং ঈশা খাঁর ২২ পরগনার মধ্যে বড় পরগনা ছিল মোমেনসিং পরগনা। এই পরগনা কার নামে হয়েছিল এখন পর্যন্ত কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। মোমেনসিং পরগনায় এই সাধকের সমাধির অস্থিত্ব বা কোন স্মৃতি চিহ্ন সরাসরি পাওয় যায়নি।
এই সব তথ্য ও বক্তব্যের সূত্র ধরে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনাসহ প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ সালে প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জরিপে সুলতান ও মুঘল আমলের নামবিহীন কয়েকটি সমাধি বা মাজার পাওয়া গিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, মোমেনসিং পরগনার গৌরীপুর উপজেলার গুজিখাঁ গ্রামে ৫/৭ শত বছর আগের দু’টি প্রাচীন স্থাপনা ছিল। সুলতানী আমলের দু’তলা বিশিষ্ট্য মসজিদ যা দুই শত বছর ধরে এই ছোট মসজিদে কেউ নামাজ পড়তে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে ১৭৮৭ এর ভুমিকম্পে নদীগুলোর দিক পরিবর্তনের সময়ে মসজিদের ২০ শতাংশ বা এর অধিক ভেঙ্গে যায়। পানি পড়তে পড়তে জঙ্গল বা ঝোপঝার পরিনত হয়। মসজিদের উপর তলা আধ্যাত্মিক ঘর এবং নিচ তলা মসজিদ। এ ছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই রয়েছে সুলতান আমলের তিন সিড়িঁ নির্মিত রওজা। মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য হিসেবে পাতলা ইটের সাথে চুন, সুরকির গাঁথুনি দ্বারা তিন সিড়িঁ নির্মিত রওজার একটি প্রকৃতি ও ধারা রয়েছে। স্থাপত্যশিল্প একটি দেশের কিংবা জাতির কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মানব সংস্কৃতির অন্যতম দৃশ্যমান প্রতীক। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় সর্বাধিক ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়েছে। এটা কার রওজা কেউ বলতে পারতো না। অনেকে ধারণা করতেন, এখানে কোন পীর বা আউলিয়া শায়িত আছেন।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মাজারের পাশে রয়েছে একটি মিনারের ধ্বংসাবশেষ পূর্বে ঝোপঝাড় ও মাটির স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। এই সব উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১ মে ১৭৮৭ সালে মোমেনসিং নাম দিয়ে জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৭৯১ ইং সালে নাসির উদ্দিনের নাম দিয়ে নাসিরাবাদ ময়মনসিংহের প্রধান জেলা শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৫৭ ইং সালে নাসিরাবাদ পৌরসভা এবং ১৮৯৯ ইং সালে নাসিরাবাদ রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯০৫ ইং সালে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তনের সময়ে গোটা শহরের নাম পরিবর্তন হয়ে যায়।
ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় দেখা যায় যে, সুলতান আমলে নাসিরুজিয়াল পরগনায় নাসিরাবাদ-১ আবার ইংরেজ আমলে আলাপসিং পরগনায় নাসিরাবাদ-২; এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে একই নামে দুই স্থানে নাসিরাবাদের অবস্থান-পূর্ব ময়মনসিংহ এবং পশ্চিম ময়মনসিংহ। আবার দু’টি স্থানের নামকরণে একই ব্যক্তি কিনা এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
কৃতজ্ঞতা: ১) ময়মনসিংহের বিবরণ- শ্রী কেদারনাথ মজুমদার ২) ময়মনসিংহের ইতিহাস- শ্রী কেদারনাথ মজুমদার ৩) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার- শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ৪) ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি- ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ ৫) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভুমিস্বত্ব- মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা ৬) বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ- আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ৭) বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)- আব্দুল করিম ৮) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন- দরজি আবদুল ওয়াহাব ৯) ময়মনসিংহের রাজপরিবার- আবদুর রশিদ ১০) নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস-আলী আহম্মদ খান আইয়োব ১১) জেমস রেনেল অংকিত প্রাচীন কয়েকটি মানচিত্র ১২) বিভিন্ন জেলার উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও গুগল এর মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী সমন্ধে অবগত ও গবেষণা
১৩) 13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar Ges A General Map of the Roads in Bengal 14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton 15) The History of British India- James Mill 16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation) 17) David Rumsey Historical Map Collection 18) New York Historical Society ১৯) ’পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ’ ম্যাগাজিন-২০১৮, ২০১৯, ২০২০- ইলেক্টোরাল কমিটি ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন, গৌরীপুর। ২০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। ২১) অমলেন্দু দে রচিত সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে। #
এপ্রিল ১১, ২০২২
রায়হান/এবি/
মন্তব্য করুন: