• ঢাকা

  •  শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ফিচার

আমার ছেলেবেলায় যেমন ছিল চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ

অমিয় দত্ত ভৌমিক

 আপডেট: ০৮:১০, ২১ এপ্রিল ২০২২

আমার ছেলেবেলায় যেমন ছিল চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ

আমার জন্ম থেকে কৈশোর পর্যন্ত কেটেছে গ্রামে। তখন যে গ্রামে ছিল মেঠো সরু আলপথ। এই আলপথ গিয়ে দুরে মিশেছে বড় কোন রাস্তার সঙ্গে। আমরা বাড়ি থেকে এই আলপথ ধরে বড় রাস্তায় উঠে স্কুল বা বাজারে যেতাম। আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেন বা কুপি বাতি ছিল সবার বাড়িতে। যেসব পরিবার একটু চলনসই ছিল, শুধু তাদের বাড়িতেই হারিকেন দেখা যেতো। এই নিভৃত গ্রামে তখনও নববর্ষ উদযাপন হতো; তবে সেটা ছিল একেবারেই সাদামাটা, কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি উযাপন করা হতো ঘটা করেই।

বছরের শেষ মাস অর্থাৎ চৈত্র মাস শেষ হওয়ার চার-পাঁচ দিন আগেই বাড়িতে চলতো সংক্রান্তির প্রস্তুতি। বাড়ির মা, ঠাকুমা এবং বড়রা চৈত্র সংক্রান্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি ঝাড়ু দেওয়া, ঘরের চারপাশে মাকড়ের বাসা পরিষ্কার করা করা থেকে কাপড় চোপড় ধোয়া ছিল প্রথম কাজ। তারপর শুরু হতো অন্য প্রস্তুতি।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনের আগের দিনটিকে বলা হতো হারি বৈসুক (ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় 'হার বিষু') আর সংক্রান্তির দিনকে বলা হয় বৈসুক (আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বিষু)। এই হারি বৈসুকের তিতা খাওয়ার প্রচলন ছিল কঠোর ভাবে। কঠোর ভাবে বলছি এই কারণে যে, বিশ্বাস ছিল এইদিনে তিতা খেলে শরীরে খুজলি বা খোসপাঁচড়া হয় না। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি, খোসপাঁচরা হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। আমার শরীরে এখনো এর দাগ আছে। তখন খোসপাঁচরার তেমন ওষুধ ছিল না বা গ্রামের মানুষ জানতো না যে এর কোনো ওষুধ হয়। ওই একটা বিশ্বাস থেকেই বিভিন্ন ধরণের তিতা খেতো সবাই। এটা যে শুধু হিন্দুরা খেতো তা নয়, আমাদের প্রতিবেশি মুসলমানরাও খেতো। এসব তিতার মধ্যে ছিল- পাটশাক, নিমপাতা, গিমা তিতা, হেলেঞ্চা, কাঁচা হলুদ, কুমারী লতা, তিতা বেগুন (স্থানীয় ভাষায় বেহই বিচি) তিতা করলা ইত্যাদি।

আমরা সংক্রান্তির আগের দিন অর্থাৎ হারি বৈসুকের দিন আমাদের জঙ্গলে কুমারী লতার খোঁজে বের হতাম বড়দের সঙ্গে। অবশ্য কৈশোরে একাই জঙ্গলে যাওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় করেছিলাম। এই কুমারী লতার গাছ বাঁশ বা অন্য গাছপালায় বেয়ে উঠতো। আবার মাটিতেও পাওয়া যেতো। মানুষ বলতো 'এই কুমাইরা ডুগা সাপে খায়' তাই পাওয়া যায় না। এই কুমারী লতার আগের নরম অংশটা আমরা তুলে আনতাম। সবাই এইদিন এটা খোঁজ করতো বলে এটা পাওয়া এদিন কঠিনই ছিল বলা চলে। তাছাড়া তিতা বেগুন বা তিত বেগুনের গাছ মেঠো পথের পাশেই প্রায়ই দেখা যেতো। সেখান থেকে তুলে আনতাম। সংগ্রহ করায় ঝোঁক থাকলেও তিতা খাওয়ায় আমার অনীহা ছিল তখন। এখন আমি গ্রামে গিয়ে কুমারী লতা বা তিতা বেগুনের সন্ধান করি কিন্তু পাওয়া যায় না।

তখন সংক্রান্তিতে ছিল নববর্ষের চেয়ে বেশি আড়ম্বর। সকাল থেকেই প্রস্তুতি চলতো। রান্নার হাড়ি পাতিল ধোয়া ছিল সকালের প্রধান কাজের একটি। কারণ সংক্রান্তি দিনে নিরামিষ খেতে হতো। সকাল সকাল সবাই স্নান সেরে নিতাম। তারপর ঘরে আর উঠানে আবির আর চালের গুড়া দিয়ে ঘরে আলপনা আঁকা হতো। দুপুরে হতো সংক্রান্তি পূজা। মা-ঠাকুমারা বিভিন্ন পদের রান্না করতেন। কখনও নয় পদ থেকে চৌদ্দ পদ পর্যন্ত রান্না হতো। দুপুরে কলা পাতা বিছিয়ে এগারো বা তেরােটি (বিজোড় হতে হবে) কলাপাতায় পূজার জন্য এসব রান্না সাজিয়ে দেওয়া হতো। তারপর মা বা ঠাকুমা 'সংক্রান্তুির কথা' (মন্ত্রের মতো) বলে এই পূজা সম্পন্ন করতেন। তারপর এই পূজার প্রথম দেওয়া হতো আমাদের শ্যাওড়া গাছের তলায় যাকে 'বাড়ান' বলা হতো তারপর আমরা এই সংক্রান্তির প্রসাদ পেতাম। এইভাবে কলাপাতায় সংক্রান্তির প্রসাদ খাওয়া ছিল খুবই উপভোগ্য। বিভিন্ন রকম তিতার সঙ্গে বিভিন্ন রকম ভাজা, তরকারি, শাক, টক আর মিষ্টান্ন থাকতো।  আর আমাদের একটা কাঁঠাল গাছ ছিল পুকুরপাড়ে এটায় চৈত্রমাসে কাঁঠাল হতো। তাই সংক্রান্তিতে কাঁঠাল থাকতো আমাদের বাড়িতে। এখনকার মতো দই বা মিষ্টি চাইলেই কিনে আনা যেতো না। এর জন্য যেতে হতো শহরে। আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই বাড়িতেই দুধের নাড়ু, নারিকেলের তক্তি, তিলের নাড়ু তৈরি করতো। আমরা এবাড়ি ওবাড়ি গেলে খেতে দিতো।

এই সংক্রান্তির দিন গৃহস্থ বাড়ির কাজের লোক গরুকে স্নান করিয়ে আবির দিয়ে সাজাতো। গোয়াল ঘরের দরজার উপরে কুমারী লতার কান্ড কেটে বেধে দিতো গরুর যাতে কোনো অসুখ-বিসুখ না হয় এই আশায়। এদিন ক্ষেতে কোনো হালচাষ হতো না।

গ্রামের এই মাথা থেকে ওই মাথা, প্রত্যেকের বাড়িতেই সাধ্যমতো চৈত্র সংক্রান্তি করা হতো। কিন্তু নতুন বছর উপলক্ষে তেমন কোনো প্রস্তুতি থাকতো না। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। তারপর মুখ ধুয়ে বাড়ির এবং প্রতিবেশি বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইতাম। নববর্ষ উপলক্ষে কোনো নতুন জামা কাপড়ের বালাই ছিল না। তবে শহরে কিভাবে এগুলো উদযাপন করা হতো তা অনুমান করতে পারতাম না। কারণ সত্তর-আশির দশকে টেলিভিশনের প্রচলন ছিল না তেমন। তাছাড়া শহরে থাকেন এমন ঘনিষ্ট আত্নীয়-স্বজন আমাদের ছিল না বললেই চলে। কিন্তু নববর্ষের দিন যে জিনিষটা ছিল তা হলো মাংস খাওয়া। এখনকার মতো তখনও একটা কথা প্রচলিত ছিল, বছরের প্রথম দিন ভালো কিছু খেলে সারাবছর ভালো কিছু খাওয়া যায়। বাবা এবং প্রতিবেশি বড়দের দেখতাম তারা খাসি কিনে আনতেন। তারপর এই খাসি বলি দিয়ে মাংস ভাগ করে নেওয়া হতো। আমরা দুপুরে মাংস দিয়ে পেটপূজা করতাম সারাবছর ভালো খাওয়ার প্রত্যাশায়।

এখন নববর্ষে যেমন মেলা হয়, তখন তেমন ছিল না। বছরে মেলা হতো শুধুমাত্র অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে। আমরা এই মেলাকে অষ্টমীর মেলা বলতাম। গ্রামের প্রত্যেক হাটেই এই মেলা বসতো একেক দিন। আমি একটা বাঁশি আর ঘুড়ি কিনতাম। আমার ঘুড়ির নেশা ছিল। অনেক ঘুড়ি উড়িয়েছি।

আরেকটা জিনিষ ছিল, হালখাতা বা পুইনাহ। নববর্ষ উপলক্ষে অনেক দোকানে এই পুইনাহ্-র আয়োজন ছিল, যা চলতো অন্তত তিন দিন। আমরা পুইনাহ করতে যেতাম। বাবা যে  দোকানগুলো থেকে বাজার সদাই করতেন সেসব দোকানীরা বাবাকে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করতেন। যদিও বাবা কোনো দোকান থেকে বাকিতে জিনিষ কিনতেন না তবুও দােকানীরা সম্মান করে বা নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে বাবাকে নিমন্ত্রণ করতেন। কিন্তু বাবা পাঠাতেন আমাকে। আমি টাকা নিয়ে দোকানে যেতাম তারপর পুইনাহ করলে দোকানী মিষ্টি খেতে দিতেন। আমি দোকানে বসে মিষ্টি জাতীয় জিনিষ- জিলিপি, রসগোল্লা বা গজা খেতাম। এটা আমাকে খুব আনন্দ দিতো।

আমার কাছে নববর্ষের বর্নাঢ্য আয়োজনটা আসে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন জেলা ও অনেক উপজেলা শহরে আনুষ্ঠানিক ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতে থাকে। তারপর একই দশকের শেষের দিকে রাজধানীতে এসে নববর্ষের যে এতো বড় আয়োজন হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করলাম। এর পর থেকে ধীরে ধীরে মন থেকে সরে যেতে থাকলো আমার শৈশব আর কৈশোরের সেই আড়ম্বরপূর্ণ চৈত্র সংক্রান্তি, তিতা খাওয়া আর কলাপাতায় দুপুরের প্রসাদ। আর প্রভাব ফেলতে শুরু করলো নববর্ষের লোকাচার অথবা বাংলা সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখ উদযাপন। 

এখন সূর্য মধ্য গগণে বা অস্তাচলের পথে। স্মৃতির থলে হাতিয়ে যতটুকু বের করতে পেরেছি শেয়ার করলাম সবার সঙ্গে। এখন শুধু মনে হয়-
বছরটা নতুন তবে
পুরনো হাসি মাখা,
যেন পুরনো কাঁথা
নতুন কাপড়ে ঢাকা।

[লেখক: একজন সংবাদকর্মী]

এপ্রিল ১৪, ২০২২

মন্তব্য করুন: