• ঢাকা

  •  বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

ফিচার

পৃথিবীতে যেভাবে শুরু হলো ঈদ উদযাপন

নিউজ ডেস্ক:

 আপডেট: ২১:১৮, ২ মে ২০২২

পৃথিবীতে যেভাবে শুরু হলো ঈদ উদযাপন

বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আরবি ঈদ শব্দের মানে খুশি, আনন্দ বা উৎসব। মুসলমানদের জন্য ঈদ পালন ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয়। কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষ হয়তো জানেন না যে, কবে থেকে ঈদ উদযাপন শুরু হয়েছিল।

বাংলাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করেন ঈদুল ফিতরকে। এই সময়ে ব্যাপক কেনাকাটা চলে- অর্থাৎ সারা বছরে যত পণ্য আর সেবা কেনাবেচা হয়, তার বড় অংশটি হয় এই সময়ে।

ঈদ ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও এই ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথেই কিন্তু ঈদের প্রচলন শুরু হয়নি। ঈদুল আযহা কখন আর কোন প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। কিন্তু ঈদুল ফিতর কখন আর কিভাবে প্রচলিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে তথ্য কমই জানা যায়।

ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে ঈদের প্রবর্তন করা হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরী সাল গণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরী সাল গণনা শুরু করা হয়েছিল আরো ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের সময়ে।

তিনি বলেন, হিজরী প্রথম বছরের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা বাধ্যতামূলক করার আয়াত নাজিল হয়, এবং তখন নবম মাস অর্থাৎ রমজান মামে একমাস সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়। এরপর হিজরী দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেয়া হয় যে, রমজান মাস (চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে) শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে।

'ঈদের সামাজিকতা ওই সময় থেকে শুরু হয়', বলেন অধ্যাপক আতাউর রহমান।

এ বিষয়ে আনাস নামে নবী মুহাম্মদের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, মদিনায় যাওয়ার পর নবী দেখলেন যে সেখানকার মানুষ বছরে দুইটি বড় উৎসব পালন করে। তিনি তখন জানতে চান, সেগুলো কী উৎসব?

তখন তাকে জানানো হলো যে, এগুলো ছিল নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দুটি উৎসব- যেগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হতো।

অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, তখন ওই দুইটি উৎসবের আদলে মুসলমানদের জন্য বছরে দুইটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন করা হয়। ঈদের প্রচলন নিয়ে এর বাইরে আর কোন বক্তব্য বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ঈদ উদযাপন মদিনায় শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয়ে যায় ঈদ পালন। কালক্রমে অঞ্চল ভেদে এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়।

কিভাবে পালন হতো প্রথম যুগের ঈদ? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরবি ঈদ শব্দের মানে খুশি, আনন্দ বা উৎসব। মুসলমানদের জন্য ঈদ পালন ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয়। প্রিয়জনের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সব সংস্কৃতিতে প্রচলিত। ঈদ পালনের কিছু নিয়ম ইসলামে নির্দিষ্ট করা আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, যা সব মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়। এ ছাড়া ঈদুল ফিতরে ফিতরা প্রদান করাও একটি অবশ্য পালনীয় রীতি। ফিতরা ঈদের নামাজের আগে অসহায় গরিব-দুঃখীদের দিতে হয়।

তিনি বলেন, যখন প্রথম ঈদের প্রচলন চালু হয়, তখন এখনকার ঈদের মতো আতিশয্য ছিল না। নবী মুহাম্মদ ঈদের দিনে গোসল করে উত্তম পোশাক পরে নামাজ পড়তে যেতেন। ঈদের নামাজের পর মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া এবং আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেওয়াজ ছিল।

বাংলায় বা বঙ্গে ঈদ কখন শুরু, কিভাবে পালন হতো, এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, দেড়শ' বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোন উৎসব ছিল না। তার মতে, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদযাপনের চল শুরু হয়।

তিনি বলেন, 'তার আগে এখানে মুসলমান ছিলেন অনেক, কিন্তু তাদের রীতি-নীতির মধ্যে লোকায়ত ধর্মের মিল ছিল বেশি। যে কারণে ওই সময়ে ঈদ উদযাপনের তথ্য তেমন পাওয়া যায় না।'

মুঘলরা ঢাকায় এসেছিল ১৬১০ সালে। তখন তাদের পাঠানো নায়েব-নাজিমরা ঈদ উদযাপন করতেন। অধ্যাপক মামুন বলেন, 'ঈদের চাঁদ উঠলে তারা আনন্দ-উৎসব শুরু করতেন। কামান দাগা হতো। ঈদের দিন তারা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন, নামাজ পড়ে ফেরার পথে হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে তারা সাধারণ মানুষের দিকে পয়সা ছুঁড়ে দিতেন। ঈদ তাদের নিজেদের মধ্যেই উদযাপিত হতো, সাধারণ মানুষের তার সাথে সংযোগ ছিল না।'

তিনি আরও বলেন, মুঘলদের তৈরি ঈদের একটা প্রতীক এখনো ঢাকায় আছে, সেটি হচ্ছে ধানমন্ডি ঈদগাহ।

মুনতাসির মামুন বলেন, এর আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে রোজা বা ঈদ পালনের তেমন চল ছিল না, সেই সাথে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো ছিল না।

উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে যখন এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন ঈদ পালনও বাড়তে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায়। এক সময় দিল্লির মুঘলদের অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো।

ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ যেমন ব্যাপক উৎসবের আকার পেয়েছে, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর - যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে। তার আগে, ঈদ উদযাপনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। আনুষ্ঠানিকতার প্রায় পুরোটাই ছিল ঢাকা-কেন্দ্রীক, যে কারণে ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঢাকার ঈদ সম্পর্কেই জানা যায়।

১৮৮৫ সালে ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের লেখা উল্লেখ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, সেই সময় গ্রামাঞ্চলে ঈদের উদযাপন একেবারে কম ছিল- এমনকি অনেক জায়গায় ঈদের নামাজ কিভাবে পড়তে হয়, তা-ও অনেকে সঠিকভাবে জানতেন না। মসজিদের সংখ্যাও সে সময়ে কম ছিল। এখন ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যেমন বেড়েছে, তেমনি মুসলমানের সংখ্যাও বেড়েছে, ফলে ঈদ উদযাপনের পরিধিও বেড়েছে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'বর্তমানে যেভাবে ঈদ দেশজুড়ে বড় একটি উদযাপনে পরিণত হয়েছে, তার একটা বড় কারণ ঈদকে ঘিরে তৈরি হওয়া অর্থনীতি।' সূত্র: বিবিসি বাংলা

মে ২, ২০২২

এসবিডি/এবি/

মন্তব্য করুন: