• ঢাকা

  •  শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

ফিচার

কবিগুরুর স্মৃতি বিজরিত কালের সাক্ষী আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি

শাহ্ আলম ভূঁইয়া

 আপডেট: ০৯:৩১, ৪ জুন ২০২২

কবিগুরুর স্মৃতি বিজরিত কালের সাক্ষী আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি

ভবনের ওপর  সুবিশাল টিনের গম্ভুজ বিশিষ্ট আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ির একাংশ। 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত কালের সাক্ষী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়িটিকে রাজবাড়িও বলা হয়ে থাকে। জমিদারের দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকাগুলো এখন আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ হিসেবে কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। চমৎকার কারুকার্যময় এ জমিদার বাড়িটি ভগ্নদশার মাঝেও প্রায় আড়াই’শ বছর ধরে তার ঐতিহ্য নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।

অনুসন্ধানী নানান তথ্য উপাত্তে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি সমৃদ্ধ এলাকা আঠারবাড়ী। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই এলাকাটি ব্যবসা-বাণিজ্যে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রসর ছিল। এমন একটি সমৃদ্ধ এলাকায় জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়ের পরিত্যক্ত দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল জমিদার বাড়িটি ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। চমৎকার কারুকার্যময় এ রাজবাড়িটির বয়স প্রায় আড়াইশত বছর বলে ধারণা করা হয়। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ির অবস্থান। মূলত এই জমিদার বাড়ি থেকেই এই গ্রামের নাম আঠারবাড়ী হয়েছে। বর্তমানে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম আঠারবাড়ী। ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে আঠারবাড়ী আগে থেকে অনেক অগ্রসর। পাইকারি জিনিষ কিনতে আশেরপাশের দু'এক জেলার মানুষ এখানে আসেন।

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হোসেন শাহী পরগনা রাজশাহী কালেক্টরের অধীনে ছিল এটি। সে সময় মহারাজ রামকৃষ্ণের জমিদারি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলে এপরগনাটি “খাজে আরাতুন” নামে এক আর্মেনীয় ক্রয় করেন। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে আরাতুনের দুই মেয়ে বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা ও তাঁর দুই আত্মীয় স্টিফেন্স ও কেসর্পাজ প্রত্যেকে চারআনা অংশে এ পরগনার জমিদারি লাভ করেন।

আঠারবাড়ী প্রাচীন জমিদার বাড়ির মূল ফটক

১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আঠারবাড়ীর জমিদার সম্ভু রায় চৌধুরী, বিবি এনিজার অংশ কিংবা মতান্তরে কেসপার্জের অংশ কিনে নেন। পরে মুক্তাগাছার জমিদার রামকিশোর চৌধুরীর জমিদারি ঋণের দায়ে নিলামে উঠলে তা সম্ভু রায়চৌধুরীর পুত্র মহিম চন্দ্র রায়চৌধুরী কিনে নেন।

শুধু তাই নয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে) মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরীর স্ত্রী জ্ঞানেদা সুন্দরীর স্বামীর উত্তরাধিকার ও ক্রয় সূত্রে পরগনায় ১৪ আনার মলিক হন। বাকি দুই আনা অন্য এলাকার জমিদাররা কিনে নেন। জমিদারী প্রতিষ্ঠার পর তাদের আয়ত্তে আসে উত্তর গৌরীপুরের রাজবাড়ী, পশ্চিমে রামগোপালপুর, ডৌহাখলা দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর ও নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। তাছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার কয়েকটি মৌজা। তাছাড়া শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বেশ কিছু মৌজাও ছিল এই জমিদারের দখলে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে এসব জেলা শহরে স্থাপিত আঠারবাড়ী কাচারি বাড়িতে নায়েব উপস্থিত হয়ে খাজনা আদায় করতেন। ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর-সহ বিভিন্ন স্থানে আজও এসব কাচারি বাড়ি “আঠারবাড়ী বিল্ডিং” নামে পরিচিতি রয়েছে।

জমিদার সম্ভু রায়চৌধুরীর পিতা দ্বীপ রায়চৌধুরীর প্রথম নিবাস ছিলো বর্তমান যশোর জেলায়। তিনি যশোর জেলার একটি পরগনার জমিদার ছিলেন। সুযোগ বুঝে এক সময় দ্বীপ রায়চৌধুরী তাঁর পুত্র সম্ভু রায়চৌধুরীকে নিয়ে যশোর থেকে আলাপ সিং পরগনায় অর্থাৎ আঠারবাড়ী চলে আসেন। আগে এ জায়গার নাম ছিলো শিবগঞ্জ বা গোবিন্দ বাজার। দ্বীপ রায়চৌধুরী তার পুত্রের নামে জমিদারি ক্রয় করে এ এলাকায় এসে দ্রুত আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং এলাকার নাম পরিবর্তন করে তাদের পারিবারিক উপাধি “রায়” থেকে "রায় বাজার” রাখেন। এই রায় বাজারটি এখনো একটি বৃহৎ বাজার হিসেবে টিকে আছে।

সেই সময় রায় বাবু একটি অংশে এক একর জমির উপর নিজে রাজবাড়ি, পুকুর ও পরিখা তৈরি করেন। রায় বাবু যশোর থেকে আসার সময় রাজ পরিবারের কাজকর্ম দেখাশুনার জন্য ১৮টি হিন্দু পরিবার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এই পরিবারগুলোর কাজ ছিল রাজবাড়ি তৈরি-সহ তাদের (রায় বাবুর) প্রয়োজনীয় সব কাজকর্ম করে দেওয়া। তখন থেকে এই জায়গাটি আঠারবাড়ী নামে পরিচিতি লাভ করে। দ্বীপ রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সম্ভু রায়চৌধুরী জমিদারি লাভ করেন। তবে তাঁর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি নান্দাইল উপজেলায় খারুয়া এলাকা থেকে এক ব্রাহ্মণ শিশু প্রমোদ রায় চৌধুরীকে দত্তক এনে লালন পালন করেন। একসময় জমিদারির কর্ণধার হিসেবে প্রমোদ রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন।

আঠারবাড়ী প্রাচীন জমিদার বাড়ির মূল ফটক

১৯২৬ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আঠারবাড়ী জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে একবার এসেছিলেন। আঠারবাড়ীর তৎকালীন জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়চৌধুরীর আমন্ত্রণে কবিগুরু ট্রেনে করে বেড়াতে এলে তাঁকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অভিবাদন জানানো হয়। আঠারবাড়ী রেলস্টেশন থেকে কবিকে হাতির পিঠে বসিয়ে জমিদার বাড়ির মূল ফটক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। মূল ফটকে পৌঁছার পর কবিগুরুকে সোনার চাবি উপহার দেন জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়চৌধুরী। ওই চাবি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাচারি ঘরের মূল ফটক খোলেন। সেখানে তার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়।এ ছাড়াও বাউল, জারি-সারি গানের আসর বসানো হয়েছিল।

বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা (ভুঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত) বই থেকে জানা যায়, কবিগুরু ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে আঠারবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সেদিন তাঁকে একনজর দেখার জন্য ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরিপুরের হাজার হাজার মানুষ ঈশ্বরগঞ্জ সদরে চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দিয়েছেলেন।

আঠারোবাড়ির জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী শান্তিু নিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন। কবিগুরু মূলতঃ প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে আঠারোবাড়ি এসেছিলেন। কবির এ সফরটি সে সময় ভারত বিচিত্রা সাময়িকীতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। 

কথিত আছে 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে" কবিগুরুর বিখ্যাত এ লেখাটি আঠারবাড়ীর জমিদারের শানবাঁধানো পুকুরঘাটে বসে লিখেছিলেন।

কবি ও কথাসাহিত্যিক সুফিয়া বেগমের সাথে আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি ভ্রমণে লেখক শাহ্ আলম ভূঁইয়া। 

এই জমিদারবাড়িকে ঘিরে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ। এর পাশে আছে আঠারবাড়ী এম সি উচ্চ বিদ্যালয়। কলেজের প্রধান ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে বিশাল খেলার মাঠ এবং তার বিপরীতে জমিদার বাড়ির অন্দরমহল। অন্দরমহলে নাচের জায়গা, চাকর-বাকরদের থাকার ঘর, সুবিশাল একটি অট্টালিকা চোখে পড়বে যার প্রতিটি কাজ সুন্দর কারুকার্যময়।

কলেজ ক্যাম্পাস অংশে রয়েছে কাচারি বাড়ি ও দরবার হল। ভবনের উপরে রয়েছে সুবিশাল এক টিনের গম্ভুজ। পিছনে সারি সারি বৃক্ষ-বনানী। রয়েছে রাণী পুকুর। এই পুকুরে আসা যাওযার জন্য অন্দরমহল থেকে গোপন সুরঙ্গপথ ছিল বলে জানা যায়।

দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল জমিদার বাড়িটি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। এই জমিদার বাড়িটির নান্দনিক কারুকার্য ও সবুজে ঘেরা কোলাহলমুক্ত পরিবেশ সবার দৃষ্টি কাড়ে নিঃসন্দেহে। চমৎকার কারুকার্যময় স্থাপনাগুলো বর্তমানে পুরোনো হয়ে শ্যাওলা ও আগাছা পড়ে দিনদিন অযত্নে খসে পড়ছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজের আয়োজনে প্রতি বছর কবিকে স্মরণ করা হয়। আয়োজন করা হয় আলোচনাসভা, কবিতা পাঠের আসরসহ নানান কর্মসূচি।

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অজয় কিশোর রায় চৌধুরীর সাথে কথা বললে তিনি জানান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক মহাসমুদ্রের নাম। তিনি বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা এই তিন দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। তাঁর স্মৃতিকে আমরা বরাবরই সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। ইতোমধ্যে জমিদার বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের তালিকায় স্থান পেয়েছে।

অপরদিকে স্থানীয়রা জানান, দেশের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের অনন্য শৈল্পিক নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধ এ জমিদার বাড়ি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অবহেলায় আড়াইশ বছরের পুরনো এ জমিদার বাড়ীটি বিলুপ্তির পথে। অথচ আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি ময়মনসিংহ বিভাগের একটি সমৃদ্ধ এলাকা, যেখানে ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই এলাকাটি ব্যবসা-ব্যাণিজ্যে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রসর। মনোমুগ্ধকর এ এলাকাটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁরা সরকারের কাছে দাবি জানান।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান, বরেণ্য কথা সাহিত্যিক, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদেরও স্মৃতি বিজরিত এই জমিদার বাড়িটি।  হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অমর সৃষ্টি ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চন্দ্রকথা’ চলচিত্রের চিত্রনাট্য ধারণ করেছিলেন এই জমিদার বাড়িতে। কালের পরিক্রমায় আঠারোবাড়ির জমিদার বাড়িটি  অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে আছে আজও আমাদের মাঝে।

লেখক: প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক স্বজন, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান - সহানুভূতি ফাউন্ডেশন, নান্দাইল, ময়মনসিংহ। 
[তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ময়মনসিংহের ইতিহাস গবেষকদের বিভিন্ন লেখা ও বই ইত্যাদি]

এসএবি/এবি/

মন্তব্য করুন: