• ঢাকা

  •  শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

অর্থ ও কৃষি

ভ্রাম্যমাণ মৌচাষে সফলতা, বছরে ৬-৮ টন মধু উৎপাদন করেন অয়েজ কুরুনী

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি:

 আপডেট: ১৫:০৮, ২৪ জুন ২০২২

ভ্রাম্যমাণ মৌচাষে সফলতা, বছরে ৬-৮ টন মধু উৎপাদন করেন অয়েজ কুরুনী

ছবি: সময়বিডি.কম

চুয়াডাঙ্গা: রাস্তার অদূরে একটি আম বাগানের ভেতর সারি সারি বাক্স। ফুলে ফুলে উড়ছে অসংখ্য মৌমাছি। বাক্সগুলোর চারপাশেও মৌমাছির ওড়াউড়ি ও আনাগোনা। ফুলে ফলে পরাগায়ণ আর বাক্সগুলোর মধ্যে ছোটাছুটি দিনভর। আর এর মধ্যদিয়ে আহরণ হচ্ছে হাজার হাজার কেজি মধু। শুধু যে মধু আহরিত হচ্ছে তা নয়, ফুলে ফুলে মৌমাছির ওড়ে বেড়ানোতে যে পরাগায়ণ হচ্ছে তাতে বাম্পার ফলন হচ্ছে ফসলের। অর্থাৎ মৌমাছি চাষে দুই দিকে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা।

মধুচাষী মুহাম্মদ অয়েজ কুরুনী (৩৬) বিভিন্ন মৌসুমে মধু সংগ্রহ করেন। তিনি বিগত ২০১০ সাল থেকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মধু চাষ করছেন। 

ভ্রাম্যমাণ মধুচাষী মুহা. অয়েজ কুরুনী সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার পারশোখালী গ্রামের মো. ইউনুছ আলী সর্দ্দারের ছেলে। দারিদ্রতার কারণে পড়াশুনা করতে না পারা অয়েজ কুরুনী এখন বছরে আয় করেন দুই থেকে তিন লাখ টাকা।

সাতক্ষীরার একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে মধু চাষের প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন তিনি। এরপর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে বর্তমানে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মধু চাষ করে অয়েজ কুরুনী তার নিজ এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। 

২০১০ সালে মাত্র ৪০টি মধুর বাক্স নিয়ে শুরু হয় অয়েজ কুরুনীর পথচলা। এখন তার খামারে দেড় শতাধিক মধুর বাক্স রয়েছে। যেগুলোর প্রতিটির মূল্য সাত থেকে আট হাজার টাকা। বছরে প্রায় ৬-৮ টন করে মধু উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর পাশাপাশি এসকেএফ ওষুধ কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে মধু সরবারহ করেন তিনি। তার এই সফলতা দেখে ওই এলাকার বেকার যুবকরা মধুচাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের একটি আমবাগানে গড়ে তোলা ভ্রাম্যমাণ মৌমাছির খামারে গিয়ে কথা হয় অয়েজ কুরুনীর সাথে। তিনি সময়বিডি.কম-কে বলেন, শখের বসেই ২০১০ সালে এক লাখ টাকা দিয়ে মাত্র ৪০টি মধুর বাক্স কিনে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ শুরু করি। পরে মধুর বাণিজ্যিক চাষ করে আসছি। বর্তমানে আমার মধু খামারে তিন জন সহযোগী আছেন। এ বছর আট টনের বেশি মধু পাওয়া যাবে।

অয়েজ কুরুনী সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দা হলেও তিনি শুধু গ্রামেই নয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মধু আহরণ করেন।

তিনি জানান, তার ১০০টি দ্বিতল বাক্স এবং ৫০টি সিংগেল বাক্স আছে। দ্বিতল বাক্সে ১২টি করে ফ্রেম এবং সিংগেল বাক্সে ৭টি করে ফ্রেম থাকে। প্রতি ফ্রেমে দেড় থেকে দুই হাজার মৌমাছি থাকে। বাক্সগুলোর প্রত্যেক ফ্রেমে দেয়া হয় একটি করে রাণী মৌমাছি। একটি ফ্রেমে দুইটি রাণী মৌমাছি থাকলে সকল মৌমাছি উড়ে যায়। এসব বাক্স থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৬০০ কেজির মতো মধু পাওয়া যায়। 

মধু সংগ্রহের জন্য কাঠ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে এই বাক্স। যার ওপরের অংশটা মোড়ানো রঙ্গিন পলিথিন ও চট দিয়ে। পরে বাক্সগুলো মৌসুমী অনুযায়ী সরিষা, তিল, জিরা, কুল বা লিচুর ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। সরিষার ফুলে মধুর ফলন বেশি হয়। মানও ভাল হয়, বলেন তিনি।

তিনি আরো জানান, নভেম্বর মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত মৌবাক্স থেকে আয় করা সম্ভব হয়। জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তেমন কোনো ফুলের সমারোহ না থাকায় মৌমাছি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এ সময় তাদের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় এ মৌসুমে মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার চিনিসহ অন্যান্যা খাবার ও ওষুধ লেগেছে। এভাবে ৫ মাস খাদ্য দিতে হয়।

অয়েজ কুরুনী বলেন, এভাবে মধু চাষ করতে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। আমার ১৫০টি বাক্সে এখন মেলেফিরিয়া জাতের মৌমাছি রয়েছে। এটি তিন ধরনের হয়ে থাকে। পুরুষ, স্ত্রী ও শ্রমিক মৌমাছি। শ্রমিক মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে নিয়ে আসে। আর স্ত্রী ও পুরুষ মৌমাছির কাজ হচ্ছে শুধু বংশ বৃদ্ধি করা। বাক্সের ভেতরে কাঠের তৈরি ফ্রেমের সঙ্গে মোম দিয়ে বানানো বাক্সগুলো ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। আমি সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখি। আমি সরিষা ফুলের মধু ছাড়াও কালোজিরা, লিচু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করি।

ভ্রাম্যমাণ মধুচাষী অয়েজ কুরুনী বলেন, ২০১০ সাল থেকে মধু চাষ শুরু করেছি। এ পর্যন্ত কী পরিমাণ মধু উৎপাদন করেছি যা হিসাব করা অসম্ভব। অন্তত ৩০ থেকে ৪০ টন মধু উৎপাদন হয়েছে। আমি প্রায় এক কোটি টাকার মধু বিক্রি করেছি ঢাকা, সিলেট, চট্টগাম ও ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকায়।

গত বছর প্রতি কেজি মধু ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। গাছি মধু সংগ্রহকারীরা মৌচাকে চাপ দিয়ে সংগ্রহ করেন। এতে মধুর গুণাগুণ ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। আর আমার খামারে যন্ত্রের সাহায্যে বাতাস দিয়ে সংগ্রহ করি। এতে আমাদের মধুর গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে। বাজারে খাঁটি মধুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যোগ করেন তিনি।

সাফল্যের নাগাল পাওয়া অয়েজ কুরুনী আগামী বছর আরো শতাধিক মৌমাছির বাক্স তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। মধু চাষ শুরু করে তার ভাগ্যের চাকা অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে তিনি অনেকটাই স্বাবলম্বী উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা উদ্যোক্তা হবেন তাদের আগে মধু চাষ শিখতে হবে। কোনো ব্যবসায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া সাফল্য অর্জন করা যায় না।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সময়বিডি.কম-কে বলেন, মৌচাষের উপর বেকার যুবকদের আগ্রহ বেড়েছে। ভ্রাম্যমাণ মৌচাষীরা সরিষার ফুল ছাড়াও কালোজিরা, লিচু ও বনের ফুল থেকে মধু আহরণে মনোযোগী হচ্ছেন। এতে করে মৌচাষ ও মধু আহরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা এই মধু চাষ করছেন তারা আমাদের এলাকার স্থায়ী কেউ না। তারা ভ্রাম্যমাণভাবে মধুর চাষ করছে। 

মৌচাষী অয়েজ কুরুনীর মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন করে এ জেলাতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাজারে খাটি মধুর চাহিদা ব্যাপক। তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ করেন তাহলে লাভবান হওয়া সম্ভব, বলেন তিনি।

জুন ২৪, ২০২২

সালাউদ্দীন কাজল/এবি/

মন্তব্য করুন: