• ঢাকা

  •  মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

সাহিত্য-সংস্কৃতি

ছােট গল্প

সাবস্ক্রাইব

ইকবাল কবীর রনজু

 আপডেট: ১৪:৪৬, ২২ জুলাই ২০২২

সাবস্ক্রাইব

বাড়ির উঠোনে পুরনো বাইসাইকেলটি মুছে, ঘষে, মেজে তাতে মবিল দিচ্ছিল নরসুন্দর কৃষ্ণ। বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গেছে। অন্যদিন এতক্ষণে সেলুনে চলে যায় সে। আজ ভাত হতে দেরি হওয়ায় বেরুতে দেরি হচ্ছে। কৃষ্ণর মা গামছা দিয়ে ভাতের বাটি মুছে কৃষ্ণর হাতে দেয়। বাটিটা সাইকেলের হেন্ডেলের সাথে বেঁধে গ্রামের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দোকানে যায় কৃষ্ণ।

সেলুনের সামনে পৌঁছে সাইকেল ষ্ট্যান্ড করতেই কৃষ্ণর নিয়মিত কাস্টমার কালু মিয়া চুল কাটাতে আসে। কালু মিয়ার অভিযোগ ইতোমধ্যে একবার এসে ঘুরে গেছে সে। কৃষ্ণর এত দেরি কেন তাও জানতে চায় সে।

ঘর ঝাড়ু দিতে দিতেই কৃষ্ণ জানায়, বাড়িত এটু কাম আছিল রে গ্যাদা। আচ্ছা আয়, বয় চুল দাড়ি কাট্যা দিচ্ছি। বাহিরের নলকূপ থেকে পানি আনতে যায় কৃষ্ণ। কালু মিয়া রিভলবিং চেয়ারে বসে পুরোনো পেপার পড়তে থাকে। কৃষ্ণ পানি নিয়ে সেলুনে ঢুকে মনযোগ সহকারে চুল কাটার কাচি, চিরুনি পরিষ্কার করে চুল কাটার কাজ শুরু করে।

পেটমোটা মফিজ কৃষ্ণর কাছের মানুষগুলোর একজন। সুদে টাকা খাটায় বলে মফিজকে অনেকে এড়িয়ে চললেও কৃষ্ণ এড়িয়ে চলতে পারেনা। প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে কৃষ্ণও চড়া সুদে টাকা নেয় মফিজের নিকট থেকে। সময়মতো আবার দিয়েও দেয়। তাই মফিজের সাথে কৃষ্ণর হৃদ্যতাও বেশ খানিকটা গভীর। মফিজ দোকানে প্রবেশ করে স্মার্ট ফোন বের করে ইউটিউবে নাটক দেখতে থাকে।

মফিজ চুল কাটবে কিনা জানতে চায় কৃষ্ণ। ইউটিউবে বেশি মাত্রায় মনযোগ থাকায় কৃষ্ণর কথা হয়তো মফিজের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। কৃষ্ণ মফিজের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফের চুল কাটায় মনযোগী হয়। চুল কাটা শেষ হলে কালু মিয়া মফিজের পাশের চেয়ারটায় বসে, মফিজ ইউটিউবে কি খুঁজছে জানতে চায়। প্রত্যুত্তরে মফিজ জানায়, ইশারত ভাইয়ের কাছে শুনলাম আলেফা কমিশনারের বিড়াল নিয়ে নাকি পাবনার আলাউদ্দিন ভাই “ফোরটি টু ক্যাটস মাদার” নামের একটা প্রতিবেদন তৈরি করে ইউটিউবে ছাড়ছে, ঐটাই খুজছি। এরই মধ্যে নাকি ৪০ লাখ ভিউ হইছে।

কৃষ্ণ: ভিউ হলি কি হয় ভাই?
মফিজ: যত বেশি ভিউ হবি তত বেশি টেকা। তুই নাপিত মানুষ। লেখাপড়া জানিস না। তুই কি বুঝবু?
কৃষ্ণ: তোমরা বুঝাইয়া দিলি বোঝবা না কি জন্যি কও। নাপিত বল্যা কি আমরা কিছুই বুঝি না?
কালু মিয়া: কষ্ট কর‌্যা একটা চ্যানেল দাড় করাবার পারলি খালি ট্যাকা আর ট্যাকা। 
কৃষ্ণ: কইস কি? 
মফিজ: এই তো সার্চ দিয়ে আলেফা আপার ভিডিও পাইছি। দেখ, দেখ। কৃষ্ণ, কালু মিয়া ও মফিজ ভিডিওটি দেখতে থাকে।

চুল কাটার টাকা পরিশোধ করে কালু মিয়া চলে গেলে মফিজের নিকট বিষয়টির বিস্তারিত জানতে চায় কৃষ্ণ। 
কৃষ্ণ: ভাই এবার ইটু খুল্যা কওতো। 
মফিজ: শোন ইউটিউবে চ্যানেল খুলার পর ভালো ভালো ভিডিও ছাড়া লাগে। কেউ গান ছাড়ে, কেউ নাটক আবার কেউবা কৌতুক বানায়া ছাড়ে। মেলা রকম চ্যানেল খুলা যায়। ধর তুই একটা চ্যানেল খুল্যা নাটক বানায়া তোর চ্যানেলে ছাড়লু। যারা তোর চ্যানেলে নাটক দেখপি তাগারে এমবি ফুরাবি লয়?
কৃষ্ণ: হয় তাতো। আমরা তো মোবাইলি এমবি তুল্যা ইউটিউবে ঢুক্যা নাটক দেখি। ট্যাকা ফুরয়া যায়। আবার তুলি।
মফিজ: ঠিক এই রকম। তোর চ্যানেল যদি একবার দাড়ায়া যায়, মনিটাইজেশন পায়, মেলা সাবস্ক্রাইবার হয়, প্রয়োজনীয় ওয়াচ টাইমও হয় তখন তোর খালি টেকা আর টেকা। তোর আর কোন দুঃখ থাকপি লয়। তখন মানষির চুল দাড়ি ও কাটা লাগবি লয়।
কৃষ্ণ: তুমি চ্যানেল খুলব্যার পার নাকি?
মফিজ: এতো একবারে সোজা। তোক দেখায়া দিলি তুইও পারবু।
কৃষ্ণ: তালি তুমি আমাক একটা চ্যানেল খুল্যা দেও। আগে তো নাটক করত্যামই। নাটক বানায়া চ্যানেলে ছাড়বো। জীবনে কত মানষির চুল, দাড়ি কাটল্যাম তাগারে কলিই তো আমার চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করবি। একবার চেষ্টা কর‌্যা দেখিই না। যদি ঘুর‌্যা দাড়াব্যার পারি তাতে তো তোমারে কোন ক্ষতি হচ্ছে না।
মফিজ: আচ্ছা ঠিক আছে। তোর ফোন ডা দে, চ্যানেল খুল্যা দেই। কি নাম দিবু চ্যানেলের কিছু ভাবছু নাকি।
কৃষ্ণ: এতে আর ভাবা ভাবির কি। তুমিই একটা নাম দ্যাও।
মফিজ: কৃষ্ণ টিভি নাম দিল্যাম। সংক্ষেপে কেটিভি।
কৃষ্ণ: তাই দেও।
মফিজ কৃষ্ণর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য শুনে শুনে কৃষ্ণকে ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেয়।
মফিজ: শোন, বালুচরের হালিম নাটক লেখে, শর্ট ফিল্ম লেখে। তোক কাল একটা স্ক্রিপ্ট আনে দেবোনে।
কৃষ্ণ: তালি তো ভালই হবিনি। কাম শুরু করব্যার পারবোনে।

প্রায় দুপুর হয়ে আসায় কৃষ্ণ দোকান বন্ধ করে। সাইকেল চালিয়ে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের রাস্তায় বিজলীর সাথে দেখা হলে কৃষ্ণ সাইকেল থেকে নামে।
কৃষ্ণ:  কোনে যাচ্ছেও সোনা।
বিজলী: আমি আবার সোনা হল্যাম কবে থেক্যা।
কৃষ্ণ: সত্যি সত্যি সোনা না হলিও সোনার মতো তো?
বিজলী: এভাবে আর কত দিন। বাড়িত থেক্যা বিয়্যার কথা কচ্ছে। তুমি বিয়া করলি তারা তারি কর, না হয় আমার রাস্তা থেক্যা কাট্যা পরো। আমি আর দেরি করব্যার পারতেছি না।
কৃষ্ণ: কয় ডা মাস সময় দেও। বাড়িত একটা ঘর দিয়ে লেই। আজ একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলছি। নাটক বানায়া চ্যানেলে ছাড়বো। 
বিজলী: কলমের ক চেন না, তুমি বানাব্যা নাটক! অত নাটক করা লাগবি লয়। সোজা কর‌্যা কও কবে বিয়া করব্যা।
কৃষ্ণ: ইট্রু দেরি কর। চ্যানেল ডা দাড়ায়া লিক। তখন খালি ট্যাকা আর ট্যাকা।
বিজলী: গাছে কাঁঠাল থুইয়া তুমি গোফে তেল দেওগা। তোমার চ্যানেল দাড়াতি দাড়াতি আমি লাতি পুতির মানুষ হয়া যাবো নে। থাক যাইগ্যা বলেই বিজলী চলে যায়।
বিজলীর গমন পথে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণ। মেয়েটাকে ওর ভাল লাগতো। হয়তো বিজলীরও ভাল লাগতো কৃষ্ণকে। কৃষ্ণই প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেয়। বেশ কিছু দিন হ্যাঁ-না কোনটিই বলে না বিজলী। একদিন এ রাস্তাতেই দেখা হয় দুজনের। কৃষ্ণ ব্যাপরটি পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দিলে -- বোঝ না বলেই সেদিন দ্রুত স্থান ত্যাগ করে বিজলী। এর পর থেকে ওরা একে অপরকে ভালবাসে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে মেয়েটাকে বিয়ে করে ঘরে নিতে পারছে না কৃষ্ণ। একটা অপ্রাপ্তি বোধ কৃষ্ণকে যেন দুমরে মুচরে ভেঙ্গে ফেলে। বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় সে।

পরেরদিন শর্ট ফিল্মের স্ক্রিপ্ট হাতে মফিজ কৃষ্ণর দোকানের সামনে এসে দাড়ায়। ঠিক তখনি কৃষ্ণ ও সাইকেল নিয়ে দোকানের সামনে এসে দাড়ায়।
কৃষ্ণ: মফিজ ভাই, তোমার হাতে নাটকের স্ক্রিপ্ট?
মফিজ: হয়। তালি কবে শুটিং শুরু হচ্ছে?
কৃষ্ণ: ক্যামেড়া তো নাই। চিন্তা করত্যাছি আপাতত জুলহাসের ক্যামেড়া ভাড়া কর‌্যা কাম শুরু করি। পরে দেখ্যা শুন্যা নিজিই একটা কিনে ফালাবোনে।
মফিজ: নিজির ক্যামেড়া ছাড়া হবি লয়। আপাতত ভাড়া কর‌্যা কাম চালা। আর শোন নাটকে যারা অভিনয় করবি তাগারে সাথে কন্টাক কর‌্যা ফালা।
কৃষ্ণ: আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তালি যাই।
মফিজ: কোনে যাবু?
কৃষ্ণ: জুলহাসের ক্যামেড়া ভাড়া করি আর আর্টিস্ট গারে সাথে কথা কয়া আসি। আজ আর দোকান খোলবো লয়।

বালুচর মাঠের পূর্ব-উত্তর কোনা থেকে দুইশ' গজ পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই রাস্তার পাশে জুলহাসের দোকান। কৃষ্ণ জানে জুলহাসের ও ইউটিউব চ্যানেল আছে। ইতোমধ্যেই ও অনেক টাকা কামিয়েছে। নিজস্ব ক্যামেরা আছে। বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ করা ওর মূল পেশা ছিল। এখন ইউটিউব চ্যানেল নিয়েই ব্যস্ত। জুলহাসের দোকানে ঢুকতেই লাভলী সিনেমা হলের দিকে চোখ পরে কৃষ্ণর। এককালে সিনেমার রমরমা ব্যবসা ছিল। এ সিনেমা হলে নতুন ভালো সিনেমা আসলে প্রথম প্রথম হাউজ ফুল হয়ে যেতো। অনেক সময়ই টিকিট পাওয়া যেতোনা। ব্লাকেও অপেক্ষাকৃত চড়া দামে টিকিট বিক্রি হতো। কতদিন সিনেমা দেখতে এসে টিকিট না পেয়ে মনের দুঃখ বুকে চেপে ফিরে গেছে কৃষ্ণ তার ইয়ত্তা নেই। আর এখন? সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য যখন অনেকে অশ্লীলতাকে, সিনেমায় কাটপিস ঢুকানোকে দায়ী করতো তখন তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করতো কৃষ্ণ। কিন্তু এখন কৃষ্ণর ভাবনাটা এমন যে, অশ্লীলতা আগেও ছিল এখনও আছে হয়তো ভবিষ্যতে ও থাকবে। কেবল মাধ্যমের পরিবর্তন হয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ যারা অশ্লীলতা পছন্দ করেন এখন তারা ব্যক্তিগত ভাবে সেটা উপভোগ করেন। 

সিনেমা হল সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিনোদনের জন্য পবিারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে মানুষ যেতো। সেখানে অশ্লীলতা থাকলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক না কেন, সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও সিনেমা, শর্টফিল্ম, নাটকসহ অন্যান্য কতো কিছুই না তৈরি হচ্ছে। ঘরে ঘরে মানুষ নাটক বানাচ্ছে, সিনেমা বানাচ্ছে। সিনেমা হলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জুলহাসের দোকানে ঢোকে কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ: ভাই আমি দিন চুক্তি ক্যামেরাডা ভাড়া লেবো। কত কর‌্যা লিব্যানে?
জুলহাস: সারাদিন রাখলি দুই হাজার ট্যাকা কর‌্যা লেই। তুই নতুন চ্যানেল খুলছু এক হাজার পাঁচশ কর‌্যা দিস।
কৃষ্ণ: আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে আস্যা ক্যামেরা লিয়া যাবো নে। এখন আবার আর্টিষ্টগারে সাথে কথা কব্যার যাবো। তালি আমি গেলাম ভাই।
জুলহাস: আচ্ছা যা।

গ্রামের ভালো ভালো লোকেশনে নাটকের শুটিং শেষে শিল্পী কলাকুশলীদের টাকা চুকিয়ে দিয়ে সোজা জুলহাসের দোকানে চলে যায় কৃষ্ণ। এখন নষ্ট করার মতো এক মুহুর্ত সময় নেই তার। চ্যানেলটা দাড়িয়ে গেলে বিজলীকে বিয়ে করবে, নিজের একটা সংসার হবে এমন স্বপ্ন দ্যাখে সে। জুলহাসের দোকানে গিয়ে ফোন করে মফিজকেও সেখানে ডাকে কৃষ্ণ। জুলহাস নাটকটি এডিট করে দেয়। ইতোমধ্যে মফিজ চলে আসে। টাইটেল লিখে, থামনেইল বানিয়ে কেটিভি চ্যানেলে নাটকটি ছেড়ে দেয় মফিজ।

কৃষ্ণর জন্য মফিজ ও জুলহাস অক্লান্ত পরিশ্রম করছে এমনটা ভেবে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের জন্য পাশের দোকানে চা আনতে যেতে উদ্যত হয় কৃষ্ণ। এ সময় জুলহাস তাকে এক প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেজ সিগারেটও আনতে বলে। কৃষ্ণ হ্যাঁসূচক জবাব দিয়ে চা সিগারেট নিয়ে আসে। চা পান করতে করতে মফিজ কৃষ্ণকে জানায় - তোর চ্যানেলে ফাস্ট নাটক আপলোড করল্যাম। এখন তুই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার বাড়া। 

কৃষ্ণ: পয়লা তোমরা দুইজন সাবস্ক্রাইব করো।
জুলহাস: তালি যা কোল্ড ড্রিংকস লিয়্যা আয়।
পাশের দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসে কৃষ্ণ।
মফিজ: এই দেখ আমরা দুইজন তোর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করল্যাম। এখন তুই তোর মতো কাম চালায়া যা।
কৃষ্ণ: শোন মফিজ ভাই তোমাক চ্যানেলের কামের জন্যি ডাকলি তুমি না কয়ো না। ইটু সময় দিয়্যা আমার চ্যানেলডা দার করায়া দেও। আমি কোল টাইটেল লেখপার পারি না। তোমরা থামনেইল না কি কও উতাও বানাব্যার পারি না। ছোটবেলা থেক্যা তোমারে চুল দাড়ি কাটতেছি। তোমরা কি চাও না আমি ভাল কর‌্যা নিজির পায়ে দাড়াই?
মফিজ: এ লিয়্যা তুই চিন্তা করিস না। থাক বাড়িত যাই।
কৃষ্ণ: আমিও যাবো। জুলহাস ভাই তোমাক এডিট করার জন্যি কতো দেবো? 
জুলহাস: এক হাজার ট্যাকা দে। তোর কাছে কি আর আমি বেশি লিব্যার পারি?
কৃষ্ণ জুলহাসকে এক হাজার টাকা দিয়ে বেরিয়ে পরে।

শান্ত স্নিগ্ধ সকাল। কৃষ্ণ বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে।
কৃষ্ণর মা: শুনল্যাম কাল নাকি দোকান খুলিস নাই? আজ আবার সকাল সকাল কোনে যাবু?
কৃষ্ণ: আমি একটা চ্যানেল খুলছি। কাল নাটকের শুটিং আছিল।
কৃষ্ণর মা: কিসির চ্যানেল রে?
কৃষ্ণ: তুমি ওসব বুঝব্যা নানে।
কৃষ্ণর মা: ইটু বুজয়া ক।
কৃষ্ণ: নাটক বানায়া ইউটিউব চ্যানেলে ছারত্যাছি। শোন, চ্যানেলডা যদি একবার দাড়ায়া যায়, মেলা সাবস্ক্রাইবার হয় তখন খালি টেকা আর টেকা। তখন আর আমারে কোন দুঃখ থাকপি লয়। মানষির চুল দাড়ি আর কতদিন কাটপো?
কৃষ্ণর মা: ইডা তোর বাপ দাদার পিশা। চুল দাড়ি কাটা বাদ দিয়া তোর নাটক বানান্যা লাগবি লয়। আসার সময় গরুর খের আনিস। খের পরায় ফুরয়া গেছে।
কৃষ্ণ বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আকতারের চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে পরিচিত কিছু মানুষকে চা পান করতে দেখে দাড়িয়ে পরে। 
নরেণ: ক্যারে কৃষ্ণ শুনল্যাম তুই বেলে চ্যনেল খুলছু।
কৃষ্ণ: হয় দাদা। তোমরা বয়সে বড়। তোমারে দোয়া আশির্বাদ লিব্যার আইছি।
নরেণ: খালি মুখি দোয়া আশির্বাদ কিরম হয় রে। 
কৃষ্ণ: খালি মুখি হবি ক্যা। আমার চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করো তোমারে খাওয়াচ্ছি। হোটেল থেক্যা সিঙ্গাড়া লিয়ে আসতেছি।
নরেণ: ঠিক আছে যা, সিঙ্গাড়া লিয়ে আয়। আমি তোর চ্যানেল কেটিভি সাবস্ক্রাইব করত্যাছি। 

কৃষ্ণ সিঙ্গাড়া নিয়ে ফিরলে তার সামনে কৃষ্ণর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে নরেণ।

কৃষ্ণ: তোমাক দিয়া ছয় জন সাবস্ক্রাইবার হলো। কাল একটা নাটক ছাড়ছি। বারো জন লাইক দিছে। দুইজন কমেন্ট লেখছে। ঐযে গো এ্যাহেড না কি কয় ঐত্যা লেখছে।
পাশে বসা অন্যদের কৃষ্ণ তার চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে অনুরোধ করে। সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে বিধায় নরেণ ও অন্যদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে সাইকেল চালিয়ে আরও কিছু দোকানপাট ও পরিচিত মানুষের কাছে যায় কৃষ্ণ। দুপুর হয়ে যাওয়ায় ক্ষিধে লেগে যায় তার। দোকানের সামনে এসে সাইকেলে বসেই সূর্যের দিকে তাকায় সে। না, দুপুরতো পরায় হয়ায় গেছে আজ এ বেলা আর দুকান খোলবোই লয় মনে মনে এমনটা ভেবে বাড়ির পথে এগোয় সে।

একদিন শুটিং থেকে ভ্যান গাড়িতে করে ফিরছে কৃষ্ণ। সাথে নায়িকাসহ অন্যান্য আর্টিস্ট রয়েছে। পথিমধ্যে বিজলীর সাথে দেখা। নাটকের নায়িকার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায় বিজলী। কৃষ্ণ ভ্যান থেকে নেমে পড়ে।

বিজলী: তুমি ভ্যান থেক্যা নামল্যা ক্যা। আমি কি তোমাক নামব্যার কইছি।
কৃষ্ণ: আত রাগ করতিছ্যাও ক্যা?
বিজলী: আমি রাগ করলি তুমার কি? তালি ভালই চলত্যাছে না? নাটকের নায়িকা তো দেখল্যাম...
কৃষ্ণ: কি ভালই চলত্যাছে? তুমি কি কব্যার চাচ্ছেও? তুমি কি আমার চরিত্রর দিক আঙুল তুলতিছ্যাও?
বিজলী: না, তা তোলবো ক্যা। তোমার চরিত্র আমার চাইতে আর ভাল জানে কে? সেদিন একা পায়া...। নায়িকাডা বেশ মোটা সোটা তো তাই কল্যাম।
কৃষ্ণ: নায়িকা মোটা হলি তোমার অসুবিধ্যা কোনে। মোটা তাই অভিনয়ের জন্যি দিন এক হাজার কর‌্যা ট্যাকা দেওয়া লাগতিছে। চিকন চাকন হলি আরো বেশি দেওয়া লাগলোনে। তুমি যদি অভিনয় করল্যানে তালি তো আমি এ ট্যাকাডা বাচ্যা গেল্যামনে।
বিজলী: আমার অত নায়িকা হওয়ার ইচ্ছা নাই। বিয়্যার কতা তোমার বাড়িত কইছিল্যা? না সে সায়স হয় নাই।
কৃষ্ণ: অত রাগ কর ক্যা। তিন মাস হলো চ্যানেল খুলছি। ৬০ জন সাবস্ক্রাইবার হইছে। গুছান্যা টাকা যা আছিল তাতো পরায় শেষ। এই অবস্থায় বিয়া করি কি কর‌্যা?
বিজলী: তোমার তো আর বিয়্যা করার দরকারই নাই। থাকো যাইগ্যা। বিজলী আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। কৃষ্ণ ও হাটতে হাটতে বিপরীত দিকে চলে যায়।

বেশ কদিন পর আজ দোকান খুলেছে কৃষ্ণ। দোকান ঝাড়ু দেওয়ার সময়ই অপ্রত্যাশিত ভাবে দোকান ঘর মালিক কাঞ্চন হাজির হয় দোকানে।
কাঞ্চন: ক্যারে তোক তো দোকানেই পাই না। দুই মাসের দোকান ভাড়া বাকি। ট্যাকা দে। আজ ট্যাকা না লিয়্যা যাচ্ছি না।
কৃষ্ণ: ভাই আপাতত ভাড়া দেওয়ার মতো ট্যাকা নাই। কয় দিন দেরি কর। 
কাঞ্চন: আচ্ছা আজকের মতো গেল্যাম। রবিবারের মদ্যি ভাড়া না দিলি দোকান ছাড়্যা দিস।
কৃষ্ণ: আচ্ছা দিয়্যা দেবোনে ভাই।
আপাতত অনুরোধে ঢেকি গিলে কাঞ্চন চলে যায়। এ সময় মফিজ দোকানে এসে কৃষ্ণর সাথে কুশল বিনিময় করে।

মফিজ: ক্যারে গ্যাদা কিরম আছু?
কৃষ্ণ: আছি তো ভাই ভালই। কিন্তু চিন্ত্যা তো ফুরচ্ছে না।
মফিজ: কিসির এতো চিন্ত্যা?
কৃষ্ণ: দুই মাসের দোকান ভাড়া বাকি পরছে। তাছাড়া ক্যামেরা ভাড়া দিতি দিতি তো মল্যাম। নিজির ক্যামেরা না হলি হচ্ছে না।
মফিজ: তো ক্যামেরা একটা কিন্যা ফালা।
কৃষ্ণ: পঞ্চাশ হাজার ট্যাকার নিচে তো ভাল ক্যামেরা হবি নানে। এত টেকা আমি কোনে পাই? তোমাক একটা কতা কব্যার চাই।
মফিজ: কি কবু ক। 
কৃষ্ণ: তুমি তো সুদি ট্যাকা খাটাও। আমাক হাজার পঞ্চাশেক ট্যাকা দেওগা। ঠিক সময় মতো তোমাক সুদির ট্যাকা দিয়া দেব। কুনু ঝামেলা করবো লয়।
মফিজ: তালি সাড়ে তিনশ' ট্যাকার ষ্ট্যাম্প লিয়া সকালে বাড়ির পার আসিস।
কৃষ্ণ: যাকগে একটা চিন্তা থেক্যা বাচাল্যা।
মফিজ: থাক যাই। বাড়িত কাম আছে। বলেই স্থান ত্যাগ করে মফিজ।

পরের দিন সকালে কৃষ্ণ সাড়ে তিনশ টাকার স্ট্যাম্প নিয়ে মফিজের বাড়ি যায়। ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে স্ট্যাম্পটি মফিজের হাতে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফেরে। নতুন ক্যামেরা কিনে সেটি দিয়ে চিত্রধারণ শুরু করে কৃষ্ণ। কিন্তু এডিট করতে না পারায় প্রায়শই তাকে জুলহাসের কাছে যেতে হয়। ইতিমধ্যে পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে। কৃষ্ণ দোকান প্রায় খোলেনা বললেই চলে। আর্টিস্ট, শুটিং স্পট, চিত্র ধারণ, এডিটিং বলতে গেলে এগুলোই এখন কৃষ্ণর জগত। এর বাইরে আর কিছু ভাববার মতো সময় নেই তার। একের পর এক চেষ্টা করছে সে কিন্তু কিছুতেই এগুতে পারছে না। পাঁচ মাসে তার সাবস্ক্রইবার হয়েছে মাত্র চারশ জন। প্রয়োজনীয় ওয়াচটাইমের কাছাকাছি ও যেতে পারেনি। সব মিলিয়ে কৃষ্ণ যখন একেবারেই হতাশ এমন সময় মফিজ তাকে আরো কিছু টাকা খরচ করে চ্যানেল বুস্ট করতে বললে যৎসামান্য যে টাকা তার কাছে ছিল তা এ বাবদ খরচ করে।

একদিন দোকান খুললে মফিজ এসে বকেয়া সুদের টাকার জন্য চাপ দেয়। এক মাস সময় চেয়ে নিয়ে আপাতত চিন্তামুক্ত হয় কৃষ্ণ। মফিজ যেতে না যেতেই অদূরে দোকান মালিককে চোখে পরে কৃষ্ণর। দোকানের ভাড়া বকেয়া পরায় এবং শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দোকান খোলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল কৃষ্ণ। দোকান মালিককে দেখে দ্রুত দোকান বন্ধ করে নিমিষে অন্যদিকে চলে যেতে থাকে কৃষ্ণ। কৃষ্ণর গমন পথে তাকিয়ে থাকে দোকান মালিক কাঞ্চন।

দেখতে দেখতে মাস পেড়িয়ে যায়। একদিন সকালে মফিজ কৃষ্ণর বাড়িতে হাজির। মফিজকে আসতে দেখেই হন্ত দন্ত হয়ে কৃষ্ণ ঘরের মধ্যে ঢোকে। এ দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে কৃষ্ণর মা জানতে চায় - কি হইছে?
কৃষ্ণ: মফিজ ভাই আসত্যাছে।
কৃষ্ণর মা: মফিজ আসত্যাছে তো কি হইছে?
কৃষ্ণ: তুমি ওসব বুঝব্যা নানে। তুমি ইটু মফিজ ভাইক কয়া দেও আমি বাড়িত নাই। বলেই কৃষ্ণ ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে।
মফিজ: কৃষ্ণ। এ কৃষ্ণ। চাঁচী কৃষ্ণ কোনে গেল? ওক তো রাস্তার উপর খাড়া দেখল্যাম।
বিরস মুখে কৃষ্ণর মা জবাব দেয় - ও ঘরে।
মফিজ ঘরের দিকে উঁকি দিতেই কৃষ্ণ অপরাধীর মতো ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাড়ায়।
মফিজ: আসল তো দিচ্ছুই না সুদির ট্যাকাডা পর্যন্ত ঠিকমত দিচ্ছু না। সুদি আসলে ৯০ হাজার ট্যাকা হয়া গেছে।
কৃষ্ণ: ভাই আমি খুব বিপদে আছি। তুমি তো সবই জানো। দোকান ভাড়াও দিব্যার পারতেছি না। তোমার ট্যাকা ও শোধ করব্যার পারতেছি না। তুমি আর কয়ডা দিন সময় দেও। 
গোড়ায় বাঁধা গরুর দিকে তাকিয়ে মফিজ জানায়- তোক আগামি শনিবার পর্যন্ত টাইম দিল্যাম। এর মদ্যি ট্যাকা সুদি আসলে শোধ না করলি তোর বিপদ আছে কল্যাম। থাক। আজক্যার মতো গেল্যাম।

তুই মফিজির কাছ থেক্যা সুদির পার ট্যাকা লিয়্যা কি করছু? 
কৃষ্ণ: মা, চ্যানেল ডা চালাব্যার পারতেছি না। মফিজ ভাইর কাছ থেক্যা ট্যাকা লিয়্যা ক্যামেরা কিনছিল্যাম। এখন কি করব সেই চিন্তা করত্যাছি।

কৃষ্ণ দোকানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বাইসাইকেল বের করে দেখে হাওয়া নাই। হেটেই রওনা হয়। দোকান মালিক দূর থেকে কৃষ্ণকে দোকানের দিকে আসতে দেখে আড়ালে লুকায়। কৃষ্ণ দোকানের সামনে গিয়ে দোকান খোলার সময় দোকান মালিক আড়াল থেকে বের হয়ে কৃষ্ণর পেছনে এসে দাঁড়ায়। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দোকান মালিককে দেখে কি করবে বুঝতে পারেনা কৃষ্ণ। কৃষ্ণ দোকান খুলতেই দোকান মালিক ঘরের মধ্যে ঢুকে চেয়ারসহ কৃষ্ণর অন্যান্য জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেয়। হাউ মাউ করে কেদে ওঠে কৃষ্ণ। তার চোখ বেয়ে জলের ফোটা পরতে থাকে। জীবনে এমন পতন তার আগে আসেনি।

কৃষ্ণ: ভাই আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি সব টাকা শোধ কর‌্যা দেবো। কৃষ্ণর কথায় কান দেয়না দোকান মালিক। কৃষ্ণ তার আয়নাটা খুলতে থাকে। ক্ষুর কেচি আয়নাসহ নিজের অন্যান্য জিনিষপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে কৃষ্ণ। এসব নিয়ে বাড়ির পথে যাওয়ার সময় পথি মধ্যে বিজলীর সাথে দেখা হয় কৃষ্ণর।
বিজলী: ক্ষুর কেচি লিয়্যা কোনে যাচ্ছেও?
কৃষ্ণ: হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
বিজলী: মিয়া ছাওয়ালের মতো কানতিছ্যাও ক্যা? কি হইছে?
কৃষ্ণ: কয়েক মাসের দোকান ভাড়া বাকি পরছে। ভাড়া দিব্যার পারি নাই জন্যি মালিক দোকান থেক্যা বাড় কর‌্যা দিলো।
বিজলী: কত ট্যাকা বাঁকি হইছে?
কৃষ্ণ: ছয় হাজার ট্যাকা।
হঠাৎই বিজলীর মাথায় যেন বাজ পরার মতো কিছু একটা হয়ে গেলো। চিন্তিত বিমর্ষ বিজলী গলা থেকে সোনার চেইন খুলে কৃষ্ণর হাতে দিয়ে সেটি বিক্রি করে দোকান ভাড়া শোধ করে দিতে বলে।
কৃষ্ণ: না তা হয় না। এতোদিন তোমার সাতে প্রেম করল্যাম তুমাক কিছু তো দিব্যারই পারল্যাম না উল্টো তোমার চেন লিয়্যা বেচপো তা আমি পারবো নানে।
বিজলী: তুমাক আগেই কইছিল্যাম ঐ সব চ্যানেল ট্যানেল খুলা লাগবি লয়। তুমি আমার কতা শোন নাই। এখন বোজ। আমাক নায় বিয়্যা নাই করবার পারল্যা সংসার তো চালান্যা লাগবি। এখন কি করব্যা।
কৃষ্ণ: চ্যানেল তো মনিটাইজেশন পালো না। কতদিনি পাবি তার ও ঠিক নাই। ভাবতেছি এখন আর ঐ চ্যানেল ট্যানেল চালাবো লয়। রাস্তার পাশে কোন রকমে দোকানডা পাত্যা যা আয় হয় তাই দিয়্যা সংসার চালাবো। কুনু রকমে মফিজ ভাইর ট্যাকাডা শোধ করব্যার পারলি বাঁচি।

বিজলী: মফিজ ভাই কত পাবি?
কৃষ্ণ: ৯০ হাজার।
বিজলী: কও কি! এখন তো দেখতাছি তোমার দেশ থেক্যা পলানা লাগবিনি। 
কৃষ্ণ: থাকো যাই। সোনার চেইনটা বিজলীর হাতে দিয়ে দোয়া চায় কৃষ্ণ। সে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। চেইন হাতে কৃষ্ণর গমন পথে নির্বাক চেয়ে থাকে বিজলী। সে যেন মনের সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

কৃষ্ণ এখন ঠিকানা বিহীন নরসুন্দর। রাস্তার পাশে একটি লাঠি গেড়ে লাঠির সাথে ছাতা বাঁধে। অদূড়ে আরেকটি লাঠি গেড়ে তার সাথে আয়না বাঁধে। রাস্তাই এখন কৃষ্ণর ঠিকানা। দু'চারজন কমদামি কাস্টমার আসলে কৃষ্ণ রাস্তার পাশে টুলে বসে তাদের চুল দাড়ি কেটে দেয়। কাস্টমারকে অপেক্ষাকৃত নিচু টুলে বসতে দেয় সে। অবসর সময়ে কাস্টমারের নিকট সে তার আগের দোকানের গল্প বলে।

মফিজ পরের রবিবার কৃষ্ণর বাড়িতে যায়। কৃষ্ণকে বাড়িতে না পেয়ে এবং ইতোমধ্যে সুদের টাকা না পেয়ে মফিজের মাথা গরম হয়ে আছে। কৃষ্ণর মা জানায় - ও তো বাড়িত নাই। বাজারে গেছে। 
মফিজ: ওক শনিবার পোন্ত সময় দিছিল্যাম। ও এক ট্যাকাও দেয় নাই। আজ রবিবার।
মফিজ গরুটার দিকে এগিয়ে গরুর গলার রশি বাঁশ থেকে খুলে ফেলে। কৃষ্ণর মা বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও সেদিকে কর্ণপাত করে না মফিজ। এরপর গরু নিয়ে রেলবাজার গরু হাটের দিকে হাটতে থাকে সে। এটা বিক্রি করে সে তার টাকা সুদে আসলে আদায় করবে। কৃষ্ণর মা কাঁদতে থাকে।

পথে বিপত্তির মুখে পরে মফিজ। কৃষ্ণ বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে মফিজকে তাদের গরু নিয়ে হাটের দিকে যেতে দেখে স্তম্ভিত হয়।
কৃষ্ণ: ভাই এ না আমারে গরু। তুমি কোনে লিয়্যা যাচ্ছেও?
মফিজ: রেলবাজারের হাটে। গরু বেঁচ্যা আমার ট্যাকা তুল্যা লেব। তুই কি মনে করছু জনম জনম তোর কাছে ট্যাকা ফালা থোবো।
কৃষ্ণ: এক হাতে কাচের আয়না অন্য হাতে গরুর রশি চেপে ধরে। কোন ক্রমেই সে গরুটা মফিজকে বিক্রি করতে দিতে চায় না। এটিই যে তার শেষ সম্বল।
মফিজ: সর কল্যাম। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
কৃষ্ণ: ও ভাই এই গরুডাই আমার শেষ সম্বল। তুমি লিয়্যা যায়ো না। তোমার ট্যাকা আমি শোধ কর‌্যা দেবো। আয়না হাতে গরুর রশি আরো শক্ত করে ধরে কৃষ্ণ। টানা টানি করতে থাকে মফিজও। মফিজ সজোরে এক ধাক্কা মেরে কৃষ্ণকে ফেলে দিয়ে গরু তাড়িয়ে হাটের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কৃষ্ণর হাতে থাকা কাঁচের আয়না মাটিতে পরে ভেঙ্গে যায়। কৃষ্ণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গরুটার দিকে। আয়নায় সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হয়ে কৃষ্ণর চোখে মুখে এসে ঠিকরে পড়ছে। নাটকের স্ক্রিপ্ট, মোটা কম ভাড়ার সেই নায়িকা, জুলহাসের এডিটিং, মফিজের থামনেইল বানিয়ে দেওয়া, দোকান পাট এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে সাবস্ক্রাইবার বাড়ানো, বিজলীর মুখচ্ছবি সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পেলেও ফায়ার সার্ভিসের মোড় পেড়িয়ে যাওয়ায় কেবল মফিজ আর গরুটা কৃষ্ণর চোখের আড়াল হয়ে যায়।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক। ইমেইল: [email protected]

মন্তব্য করুন: