• ঢাকা

  •  বুধবার, মে ৮, ২০২৪

বাংলাদেশ

পানির অভাবে চলনবিলের ১৬ নৌরুট বন্ধ

পাবনা প্রতিনিধি

 আপডেট: ০৮:৫৯, ১৫ মার্চ ২০২৩

পানির অভাবে চলনবিলের ১৬ নৌরুট বন্ধ

গুমানী ও বড়াল নদীর সংযোগস্থল। একেবারেই শুকিয়ে গেছে। ১৩ মার্চ চাটমোহরের নুরনগর এলাকা থেকে ছবিটি তোলা।

পাবনা: পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যুষিত এলাকার অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে মাঘ-ফাল্গুন মাসেই। আত্রাইসহ কিছু নদী খনন করা হলেও অন্যান্য নদীগুলো বছরের পর বছর খনন না করায় অধিকাংশ নদ নদী নব্যতা সংকটে ভূগছে। ফলে ব্যহত হচ্ছে সেচকাজ। 

তাছাড়া, দেশি মৎস্যসম্পদও তাই প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যেও। অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের ১৬ নৌরুট এখন বন্ধ। স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হামিদ রচিত 'চলনবিলের ইতিকথা' গ্রন্থ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে বেয়ে আসা আত্রাই ও গুর নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পরে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী, ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্ন হতে “গুড়” নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা, যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রীমোহনায় নন্দ কুজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।

জলপাইগুড়ির উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ নিমগাছী তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক জায়গায় মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত।

বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বীতীয়ার্ধের মাঝামাঝিতে ও নদীটি স্রোতস্বীনি থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রসবাধ দেওয়ায় এ নদীটি এখন মৃতাবস্থায় পরে আছে। এ নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা কমিটি দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসার ফলশ্রুতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগরের ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হলেও পদ্মার সাথে যমুনার সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়নি।

নূরনগর থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বর্ষায় কিছুদিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায় নদীটি। চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণপাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সাথে মিশেছে। নটাবাড়িয়ায় স্লুইজগেট থাকার প্রভাবে এ নদীটি ও অস্তিত্বহীন হয়ে পরেছে এবং এ রুটে নৌচলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লুইজগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকী আট মাস পানিশূণ্য থাকে নদীটি। 

ফরিদপুরের ডেমরার এ স্লুইজগেটের কারণে চিকনাই নদীর নৌপথও বন্ধ দীর্ঘদিন যাবত। এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদীসহ চলনবিলের নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুন।

অতীতে ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নৌপথে এ এলাকায় আনতেন কিন্তু এখন তা পারছেন না। সড়ক পথে পণ্য পরিবহনে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। ক্রেতারা ও বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়িতে নিতে পারছেন না। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পরেছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন তারা। 

পূর্বে নদী থেকে কৃষক অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরো ক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারলেও এখন তা পারছেন না। উপরন্ত পানির স্তর দ্রুত নীচে নেমে যাওয়ায় অগভীর পাম্প মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই তাদের সেচপাম্প সমতল থেকে অন্তত ১০ ফুট নিচে স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আত্রাই রিভার ড্রেজিং প্রজেক্টসহ অন্য কিছু নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও তাতে নৌরুট সচল রাখা সম্ভব হয়নি।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন ও বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান জানান, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব এবং আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন মহলের খামখেয়ালী নদ নদীর উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে। আত্রাই নদীর উপর দিনাজপুরে এবং নাটোরের গুরুদাসপুরে রাবার ড্যাম স্থাপিত হয়েছে। এতে রাবার ড্যামের উজানের কিছু এলাকা লাভবান হলেও ভাটির বিস্তৃর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। 

তিনি আরো জানান, চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর ঢালের পরিমান কমে যাওয়ায় প্রবাহমান পানির পরিমানও কমে গেছে। কমে গেছে স্রোতের বেগও। পানির সঙ্গে প্রবাহিত মৃত্তিকা কনা, নূড়িকনা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনা নদীর তলদেশে জমে যাওয়ায় নদী উপত্যকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে নৌরুটগুলো বন্ধ থাকছে বেশির ভাগ সময়।

এছাড়া ব্যহত হচ্ছে প্রাণিকূলের খাদ্যশৃঙ্খল। প্রভাব পরছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। পানি সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশের। এসব নদ নদীই তো চলনবিলের প্রাণ। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে আমরা আরো বেশি ক্ষতির শিকার হবো। নদী রক্ষায় আমরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছি। দ্রুত নিয়ম নীতি মেনে খনন করে এ এলাকার নদ নদী সচল করার দাবী জানাচ্ছি।

মার্চ ১৪, ২০২৩

ইকবাল কবীর রনজু/এবি/

মন্তব্য করুন: