গৌরীপুরে ভাষা সৈনিক পিতা-পুত্রের কবর পাকাকরণ

ছবি- সংগৃহীত
ময়মনসিংহের গৌরীপুর ভাষা সৈনিক পিতা-পুত্রের কবর পাকাকরণ কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। শনিবার (২৮ জুন) দুপুরে উপজেলার বোকাইনগর অষ্টঘর গ্রামে কবর পাকাকরণ কাজের উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম সাজ্জাদুল হাসানের প্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহ্ফুজ ইবনে আইয়ুব।
ভাষা সৈনিক মৌলভী আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরীর মৃত্যুর ৫৭ বছর ও ভাষা সৈনিক আব্দুল কদ্দুছ বোকাইনগরীর মৃত্যুর ২৩ বছর পর কবর পাকাকরণের কাজের উদ্বোধন করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবর পাকাকরণ কমিটির সভাপতি ও গৌরীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী আব্দুল্লাহ আল আমীন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন উপজেলা বিএনপি’র আহবায়ক আহম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ, পৌর বিএনপি’র সদস্য সচিব সুজিত কুমার দাস, ভাষা সৈনিক মৌলভী আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরীর ছেলে আব্দুল ওয়াদুদ বোকাইগরী, আব্দুল কদ্দুছ বোকাইনগরীর ছেলে মাহমুদুল হাসান মনি, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেল, উপজেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক কাজী এনামুল হক, পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ জাহাঙ্গীর আলম, গৌরীপুর সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহবায়ক নূর মোহাম্মদ মামুন, গৌরীপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ বিপ্লব, গৌরীপুর রিপোর্টাস ক্লাবের সভাপতি মোঃ রায়হান উদ্দিন সরকার, সাংবাদিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোঃ শাহজাহান কবীর হীরা প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, ভাষা সৈনিক আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী এক সমাজ হিতৈষী, প্রখ্যাত রাজনৈতিক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৭৬ সালে নেত্রকোনা জেলার জয়সিংহ গ্রামে। তাঁর বাবা মোহাম্মদ তকি হোসেন ও মা বেগম মেহেরুন্নেছা। তাঁর শিক্ষাজীবন শেষে ১৮৯৮ সালে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে তিনি চলে আসেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বোকাইনগর অষ্টঘর প্রাইমারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১০ সনে বোকাইনগর গ্রামের ফকির বাড়িতে শাহ আবাল উদ্দিনের কনিষ্ঠা কন্যা মোছাঃ সফুরা খাতুনকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বোকাইনগরবাসী ওনার বিভিন্ন গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সম্মানের সাথে "বোকাইনগরী উপাধি প্রদান করেন। পরবর্তিতে বোকাইনগরকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তুলতে নিজের নামের সঙ্গে তিনি বোকাইনগরী সংযুক্ত করেন ও সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯০৫ সালে যোগ দেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিতে। মহাত্মা গান্ধীর সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। পরে মাও-লানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। বোকাইনগরী সাহেব সু-বক্তা হিসাবে সুখাতি অর্জন করেন। ১৯২৯ সালে প্রজা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সনে কংগ্রেস দলীয় টিকেটে লাঙ্গল মার্কায় বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদ (কলকাতার এসেম্বলি) এর সদস্য পদ লাভ করেন। কোলকাতা এসেম্বলির বাংলা বক্তব্য নিষিদ্ধ ছিল। যে কারনে মৌলভী আবদুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দিতে শুরু করলে স্পিকার তাঁকে বাংলা বক্তৃতা দিতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি তা আগ্রাজ্য করে বাংলাতেই পুরো বক্তব্য দেন। এসেম্বলিতে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেবার অধিকার নিয়ে তিনি আন্দোলন শুরু করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফূর্ত সাড়া দিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়। এ সময় তিনি কলকাতার গড়ের মাঠসহ কলকাতায় বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করে জনমত গঠন করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিবার অধিকার আদায় করেন। সদানন্দ মাঠে রাজনৈতিক জনসভায় বক্তব্য রেখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সমাজ দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটে ডাক দিলে তরুণ সমিতির উদ্যোগে গৌরীপুরের নন্দুরা গ্রামে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় সভাপতি ও প্রধান বক্তা হিসেবে জননেতা মৌলভী আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী (এমএলএ) বক্তব্য রাখেন। সভায় বাংলাকে কেন রাষ্ট্র ভাষা করতে চাই, আর উর্দুই বা চাই না কেন তার বিশেষ ব্যাখ্যা দিলেন বোকাইনগরী সাহেব। ১৯৫২তে বাংলা ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানী সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে, গৌরীপুরের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে চোঙ্গা ফুকিয়ে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে প্রচারপত্র বিতরণ, পথসভা, জনসভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল করে। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী রাজেন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গৌরীপুর-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষে জনমত গঠন করে। ময়মনসিংহ থেকে আইয়ুব শাহীর দাঙ্গা পুলিশ এসে টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিপেটা করে অবরোধ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা শহীদ হলে গৌরীপুরের ভাষা বিপ্লবীরা তৎকালীন বাজার ময়দানে (বর্তমান শহীদ হারুন পার্ক) কে ইটের উপর ইট রেখে লালসালু কাপড় দিয়ে শহীদ মিনার তৈরী করেন। পরে পুলিশ এসে সেই শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় এবং পিতা-পুত্র আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী (এমএলএ) ও তাঁর পুত্র ভাষা সৈনিক আঃ কুদ্দুস বোকাইনগরী সহ ১৮ জন ভাষা সৈনিকের নামে মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারী ভাষা সৈনিক আঃ কুদ্দুস বোকাইনগরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগ করে মুক্তি পান।
ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী নূরুল আমিনকে পরাজিত করে আওয়ামী মুসলিম লীগ (যুক্তফ্রন্ট) থেকে আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান আইন পরিষদের (এমএলএ) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেছেন।
এছাড়াও তিনি গৌরীপুর সরকারি কলেজের প্রথম গভর্নিং বডির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ছিলেন গৌরীপুর পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মৌলভী আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী (এমএলএ) ১৭ নভেম্বর ১৯৬৮ ইং মৃত্যুবরণ করেন।
এসবিডি/ওবায়দুর রহমান
মন্তব্য করুন: