• ঢাকা

  •  শুক্রবার, জুন ২৭, ২০২৫

ফিচার

রেনেলের মানচিত্রে নেত্রকোণার শিমূলকান্দি ছিল বিখ্যাত নদীবন্দর ও শহর

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

রেনেলের মানচিত্রে নেত্রকোণার শিমূলকান্দি ছিল বিখ্যাত নদীবন্দর ও শহর

নেত্রকোণা নামকরণের আগে এখনকার শিমূলকান্দি ছিল বিখ্যাত নদীবন্দর এবং ব্যবসাকেন্দ্র। বাংলার প্রধান অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর মধ্যে এই বন্দরটি প্রাচীন ও মধ্যযুগেই বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত ছিল। 

জেমস রেনেলের মানচিত্রে মগরা ও সোহাই নদীর সংযোগস্থানে শিমূলকান্দি অবস্থিত। ১৭৮৭ সালের আগে নদী দু’টি ছিল খুব প্রশস্ত , খরস্রোতা ও ভারতবর্ষের জাতীয় নদী হিসেবে পরিচিত ছিল।

তাছাড়া মোমেনসিং ও সুসং এই দুই পরগনার সীমায় অবস্থিত ছিল শহরটি। বর্তমান শিমূলকান্দি শুধু গ্রাম, এখানে একটি গ্রাম্যবাজার আছে যা মগড়া নদীর তীরে অবস্থিত।

শিমূলকান্দি ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার ৯নং খলিশাউড়  ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। শিমূলকান্দি  গ্রাম্য বাজারটি নেত্রকোণা জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে হিরনপুর বা চল্লিশা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে এবং পূর্বধলা থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। তাছাড়া নেত্রকোণা সদর ও পূর্বধলা দুই উপজেলার সীমানা ঘেষে অবস্থিত।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="460" src="//www.youtube.com/embed/9vnI8b66OJo" width="725"></iframe>

এ অঞ্চলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। মুসলিমপূর্ব যুগ অর্থাৎ কামরূপ যুগ হতে সমগ্র মুসলিম শাসন আমলে উত্তরে মেঘালয় ও আসাম থেকে শুরু করে পূর্বে সিলেট ও দক্ষিণে বোকাইনগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে উৎপাদিত হতো শিমুল তুলা ও কাপড়। এই শিমুল শব্দ হতে শিমুলকান্দি নামকরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন।

নদী তীরবর্তী নৌবন্দরগুলোর সাথে পূর্ব দিকে সিলেট, রাণীগঞ্জ, কালীগঞ্জ, মধ্যনগর, উত্তরে আসাম, মেঘালয়, নাটেরকোণা, দুর্গাপুর, বাইগনবাড়ি কুঠি, শেরপুর, হুগলী, দক্ষিন-পশ্চিমে রাঘবপুর, রাজগঞ্জ (সাহেব কাচারী), কেসারগঞ্জ (শম্ভুগঞ্জ), পরানগঞ্জ, বাইগনবাড়ি (ময়মনসিংহ শহর) ,দক্ষিণে বোকাইনগর, সরিষাহাটি, বাশাঁটি, মধুপুর, জঙ্গলবাড়ি, এগারসিন্দুর, এবং দক্ষিন-পূর্বে রামপুর, মদন, তেলিগাতি, খালিয়াজুরি, নিকলি, সোনাজুরি প্রাচীন নদীবন্দরের সঙ্গে একটি আন্তঃবাণিজ্য ব্যবস্থা ও যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। আর এ বাণিজ্য ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়েছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশসমূহে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শিমূলকান্দির গুরুত্ব আরও বাড়তে থাকে।

শিমূলকান্দি দক্ষিন দিকে দামোধরভিটি গ্রামে একটি শাহী মসজিদ আছে। পশ্চিমে ইচুলিয়া গ্রামে দামোধরভিটি গ্রামের অবিকল দুইটি প্রাচীন মসজিদ ছিল। আর ইচুলিয়া বাজারে গোসাই বাড়ি বা বৈষ্ণব আখড়া ছিল। বর্তমান সেখানে প্রাচীন বকুল গাছ ও একটি পুকুর রয়েছে।

ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চারমাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়।

মোমেনসিং পরগনায় ৮০ এর অধিক মোগল আমলের মসজিদ ছিল যা মুসলিম শাসন এবং আফগান সামরিক প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী। 

এই জরিপের অগ্রপথিক ও পরিচালক মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, ইতোমধ্যে মোমেনসিং পরগনার সমগ্র গৌরীপুর উপেজলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদের জরিপ সমাপ্ত হয়েছে। এ জরিপে মোমেনসিং পরগনার ৫৫টি মোগল আমলের মসজিদ পাওয়া গিয়েছে যা বারো ভূইয়া আমলের জলদুর্গের নিদর্শন। এইসব অমূল্য স্থাপত্যকীর্তিগুলো তৈরি হয়েছিল তৎকালীন সুলতান ও রাজাদের আমলে।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদের জরিপের উদ্দেশ্যে ৮ আগস্ট ২০২০ তারিখে শিমূলকান্দি বাজার পরিদর্শন করা হয়। 'ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়' হিসেবে শিমূলকান্দি বাজারের আশেপাশে তিনটি জমিদার বাড়ি রয়েছে। তবে জমিদারের ইতিহাস এবং শিমূলকান্দির ইতিহাস সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। 

জমিদার বাড়িগুলো হলো - পালপাড়া রাজবাড়ি, মগড়া নদীর পূর্ব পাড়ে রায়দোম রৌহা জমিদার বাড়ি ও এক বা দুই কিলোমিটার উত্তরে ধলাই নদীর তীরে নারায়ণডহর জমিদার বাড়ি।

নারায়ণডহর জমিদার রামচরণ মজুমদারের হাত ধরেই এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তন। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বংশ বা জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এই নারায়ণডহর এলাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে পাকিস্তান শাসনামল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ময়মনসিংহ বিভাগের প্রথম ইংরেজি স্কুল ১৮৪৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জমিদার বাড়ির একটি ভবন পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ঈশা খাঁর আমলে রায়দোম রৌহা জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয় প্রতাপপুর গ্রামে। প্রতাপপুর গ্রাম শ্যামগঞ্জ বাজার হতে রেল লাইন বরাবর তিন কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। 

সবচেয়ে কাছে ও বাজার সংলগ্ন রাজবাড়িটি পালপাড়া নামে বেশ পরিচিত। তবে জমিদার বাড়িটি কবে বা কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোন বাণিজ্যকুঠি ছিল। তাদের পক্ষে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বেশ কয়েকজন হিন্দু বানিয়া থাকতো।

কারও কারও মতে, বোকাইনগর জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর অধীনে ভাটি অঞ্চলে অনেক ছোটছোট জমিদাররা কাজ করতো। শিমূলকান্দি বাজারে প্রাচীনকালের চিকন ইট দ্বারা নির্মিত একটি নাথ মন্দির ছিল বলে লোকমুখে জানা যায়। প্রত্নত্বাত্তিক গবেষণা অনুযায়ি, যেসব চিকন ইট দ্বারা নির্মিত ইমারত হয়েছিল তা কমপক্ষে দু’শ বছর আগে নির্মাণ হয়েছিল। এখানে সব জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ চিকন ইট দ্বারা নির্মিত ছিল।

যতদূর জানা যায়, আজ থেকে প্রায় চারশ’ বছর আগে ইমারতগুলি স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে কিছু বড় গাছ, কয়েকটি বড় দিঘি বিদ্যমান। মাটির নীচে অসংখ্য চিকন ইটের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, ইংরেজরা দলবেঁধে এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসতো। তখন পাট, তুলা ও মসলার জন্য বিখ্যাত ছিল এই অঞ্চল। জেমস রেনেলের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে ইংরেজ আমলে বানিজ্য কুটির নির্মাণ করা হয়েছিল। বানিজ্য কুঠিরে অনেক বানিয়া আসতেন।বানিয়ারা মূলত আঠারো এবং উনিশ শতকে ইউরোপীয় বণিকদের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতো। তারা প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ছিলেন। 

ইউরোপীয় বণিকেরা সাধারণত ভারতবর্ষে আঞ্চলিক ভাষা, রীতি-নীতি, ব্যবসা কেন্দ্র, স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত পণ্যের পরিমাপ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলো না। এজন্য তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে বানিয়া নিয়োগ করতে হয়েছিল। বানিয়ারা সাধারণত দু’ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তারা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হয়ে তারা দর কষাকষি, মধ্যস্থতা এবং তহবিল সংরক্ষণ করতো এবং লেনদেনকৃত পণ্যমূল্যের দুই শতাংশ তাদের কমিশন হিসেবে প্রদান করা হতো। ইউরোপীয় ব্যাবসায়ীরা বড় নৌকা বা জাহাজ করে শিমুলকান্দির মতো বড় নদীবন্দরে পৌঁছালে তারা তাদের অভ্যর্থনা জানাতো, তাদের থাকা-খাওয়ার আয়োজন করা, তারা যতোদিন থাকতেন, ততোদিনের জন্য তাদের ভৃত্য নিয়োগ করতো, বড় নৌকায় বা জাহাজে পণ্য উঠানো ও নামানো, তাদের নিয়ে আসা রূপার টাকায় রূপান্তরিত করা, তাদের হাটবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন যোগান দেওয়া এবং বিনোদনের জন্য বিদায় সম্বর্ধনার সময় বাইজি নাচের আয়োজন করার মাধ্যমে তারা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো।

পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের লগ্নিমূল্য ও পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়, ফলে বানিয়াদের গুরুত্বও অনেক বৃদ্ধি পায়। উনিশ শতকের কলকাতা এবং বাংলায় প্রসিদ্ধ পরিবারগুলো  প্রায় সকলেই বানিয়া ছিলেন। তাদের সম্পদ দিয়ে কলকাতায় যেমন বহু প্রাসাদতুল্য ইমারত নির্মাণ করা হয়, তেমনি চিরস্থায়ী বন্ধবস্ত নিশ্চিত করার পর তারা তাদের নিজ নিজ গ্রামে জমিদারি এবং কোম্পানির বন্ড ক্রয় করেন। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানেও তাদের সে অর্থ ব্যয় করা হতো।

এই তথ্য অনুযায়ি, মগড়া নদী ও সোহাই নদীর তীরে বানিয়াদের প্রাসাদতুল্য ইমারত ছিল। নদীর পূর্বদিকে সু-প্রাচীন গ্রাম রয়েছে যা নাচনেওয়ালী গ্রাম হিসেবে এখনও বিদ্যমান।

শিমূলকান্দি নৌ বন্দরটি ধ্বংস হওয়ার কারণ, ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ এবং কিছু জায়গা উঠিত হবার কারণে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে একটি যমুনা নদী সৃষ্টি হয় এবং পদ্মার সাথে মিলিত হয়।

ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ৮০ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী  দুই তিন কিলোমিটার প্রশস্থের সোহাই নদী শত বছর আগে গাজীপুর, রঘুনাথপুর, বিসকা, কলতাপাড়া এলাকায় মরা গাঙ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিল। মগড়া নদীর প্রসস্থ অনেক ছোট হয়ে যায়। বর্তমানে শিমূলকান্দি কাছে সোহাই নদী বলতে কিছু নেই সেখানে আছে শুধু ধান ক্ষেত আর বিল।

তাছাড়া ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে অনেক রাজবাড়ি ফাটাল সৃষ্টি হলে জমিদার আমল থেকে ইমারতগুলি পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যারফলে বাড়িগুলো জঙ্গলে পরিণত হয়। যেমন লালচেপুর দালাইন্না জঙ্গল। এ জঙ্গলে প্রাচীন দালান ছিল।

যুগে যুগে নানা পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ধরনের শাসন আমলে মানুষ যে পরিবেশে বাস করতো, কালের প্রবাহে তার বিবর্তন ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বহু স্থানের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণেও গড়ে উঠে নতুন জনপদ কিংবা বিলুপ্ত হয় লোকালয়। আর এসবের পরিচয় বহন করে প্রত্ননিদর্শনসমূহ। প্রত্ননিদর্শনগুলো বর্তমানের মানুষকে নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে। এজন্য প্রত্ননিদর্শন হলো 'ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়'।

সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০

মন্তব্য করুন: