মোমেনসিং পরগনায় ইসলাম প্রচার, গৌরীপুরে কেরামতি মসজিদের সামনে ওলির মাজার!

ময়মনসিংহ অঞ্চলের কামরূপ শাসনের অবসান হলে মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করেন। বিশেষত কামরূপকে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং ভুটানের পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত বলে যাদু, যোজনা এবং যাদুবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ এবং অনুশীলনকারীদের বসবাসের এক কল্পিত এবং রহস্যময় স্থান বলে মনে করতো।
সিলেট সফরকালে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছিলেন, 'এই পাহাড়ের বাসিন্দারা যাদু এবং জাদুবিদ্যার প্রতি তাদের অনুরাগী এবং অনুশীলনের জন্য খ্যাতিমান।'
<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/uw6O4L3OtbE" width="725"></iframe>
এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর, আউলিয়া, ফকির ও দরবেশদের বদৌলতে। মুসলিম শাসকরা যখনই কোনো অঞ্চল বা স্থান জয় করেছেন, তখনই তারা সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের সুলতানি আমলের বেশ কিছু মসজিদ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।
মোমেনসিং পরগনার গৌরীপুর উপজেলার গুজিখাঁ গ্রামে ৫ থেকে ৭শ' বছর আগের দুটি প্রাচীন স্থাপনা ছিলো। সুলতানি আমলের দুতলা বিশিষ্ট মসজিদ যেখানে বিগত দুইশ' বছর ধরে এই ছোট মসজিদে কেউ নামাজ পড়তে পারেনি।
ধারণা করা হচ্ছে ১৭৮৭ এর ভুমিকম্পে নদীগুলোর দিক পরিবর্তনের সময়ে মসজিদের ২০ বা এর অধিক শতাংশ ভেঙ্গে যায়। পানি পড়তে পড়তে জঙ্গল বা ঝোপঝার পরিনত হয়। মসজিদের উপরতলা আধ্যাত্মিক ঘর এবং নিচতলা মসজিদ। এ ছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই রয়েছে সুলতান আমলের রওজা। মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য হিসেবে পাতলা ইটের সাথে চুন, সুরকির গাঁথুনি দ্বারা তিন সিঁড়ি নির্মিত রওজার একটি প্রকৃতি ও ধারা রয়েছে। স্থাপত্যশিল্প একটি দেশের কিংবা জাতির কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মানব সংস্কৃতির অন্যতম দৃশ্যমান প্রতীক। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় সর্বাধিক ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়েছে।
তাতকুড়া গ্রামের মো. হারেছ আলী বলেন, ১৯৬৮ সালে কেরামতি মসজিদে নামাজ পড়তে তিনি এসেছিলেন। তিনি আরও বলেন, মসজিদের সামনে অর্থাৎ পূর্ব দিকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা অবস্থা চিকন ও পাতলা ইটের তিন সিঁড়ি বিশিষ্ট একটা রওজা দেখেছিলেন। এটা কার রওজা কেউ বলতে পারতো না। অনেকে ধারণা করতেন, এখানে কোন পীর বা আউলিয়া শায়িত আছেন। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মাজারের পাশে রয়েছে একটি মিনারের ধ্বংসাবশেষ পূর্বে ঝোপঝাড় ও মাটির স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো।
এই সব তথ্য ও বক্তব্যের সূত্র ধরে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্সের যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়।
মোমেনসিং পরগনায় ৮০টির অধিক মোগল আমলের মসজিদ ছিলো যা মুসলিম শাসন এবং আফগান সামরিক প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী।
এই জরিপের অগ্রপথিক, পরিচালক মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, ইতোমধ্যে মোমেনসিং পরগনার সমগ্র গৌরীপুর উপেজলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদের জরিপ সমাপ্ত হয়েছে। এ জরিপে মোমেনসিং পরগনার ৫৫টি মোগল আমলের মসজিদ পাওয়া গেছে যা বারো ভূইয়া আমলের জলদুর্গের নিদর্শন। এইসব অমূল্য স্থাপত্যকীর্তিগুলি তৈরি হয়েছিল তৎকালীন সুলতান ও মুঘল রাজাদের আমলে।
তিনি আরও বলেন, গুজিখাঁ কেরামতি জামে মসজিদের আদিতে ছিল সুলতানী আমলের দু’তলা মসজিদ। এ ছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই রয়েছে সুলতান আমলের রওজা এবং ধর্মীয় ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে নির্মিত সুলতান বা মুঘল নির্মাণরীতির মিনারের অবশিষ্টাংশের কিছু অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান আছে। সেগুলাে সুলতানী ও মােগল স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
তাছাড়া বর্তমান মসজিদের দক্ষিন-পশ্চিম দিকে ও কিছুটা পেছনে পাতলা ইটের সাথে চুন, সুরকির গাঁথুনি ও পলেস্তরা দিয়ে নানা কারুকার্যখচিত ভবনটি ছিল দ্বিতল ইমারত। এখনও ভিটের কিছু অংশ অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। মাটি খনন করলে ১০/১৫ ফুট পর্যন্ত চিকন বা পাতলা ইটের স্তুপ পাওয়া যেতে পারে। বাংলা তথা মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মিত স্থাপত্যিক উদাহরণের দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি সহজে উপলব্ধি করা যায়।
হুসেন শাহ্ আমলে ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব দিক জয় করে ত্রিপুরা পর্যন্ত অধিকার করেন। এমনকি বারো ভূইয়ার শাসন আমলে সমগ্র মোমেনসিং পরগনার একটি জলদুর্গের পরিখা বা প্রাকৃতিক সীমারেখার সন্ধান পাওয়া যায়। মোমেনসিং পরগনার উত্তরে সুসং পরগনা, উত্তর-পশ্চিমে সেরপুর পরগনা, দশকাহনিয়া পরগনা, পশ্চিমে আলাপসিং পরগনা, পূর্বে খালিয়াজুরী পরগনা, পূর্বে দক্ষিনে নাসিরুর্জিয়াল পরগনা এবং দক্ষিনে হোসেনশাহী পরগনা। মধ্যযুগে আজকের সমগ্র গৌরীপুর উপজেলা ছিল মোমেনসিং পরগনার অন্তর্গত।
১৪৯৮ সালে হুসেন শাহ্ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময় সমগ্র ময়মনসিংহে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বাংলাদেশের মতো ময়মনসিংহ জেলাতেও ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল মূলত সূফী, পীর, ফকির, অলি ও বুজুর্গদের মাধ্যমে। ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য পীর ফকির দরবেশদের দরগাহ, মাযার অথবা তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ লোকস্মৃতি বিদ্যমান।এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার হুসেনশাহী পরগণা এবং হুসেনপুর নামক স্থান হুসেন শাহের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। তাছাড়া আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ্-এর জন্য মোমেনসিং পরগনার পূর্বে দক্ষিনে নাসিরুর্জিয়াল (কেন্দুয়া, তাড়াইল....) পরগনায় একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন। সেই থেকেই সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহের অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এর গবেষণা কক্ষে প্রদর্শিত বাঘা শাহী মসজিদ। বাঘা মসজিদ রাজশাহী জেলা সদর হতে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তর পাশেই রয়েছে হজরত শাহদৌলা ও তার পাঁচ সঙ্গীর তিন সিঁড়ি নির্মিত মাজার।এ ছাড়াও এ মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাজার রয়েছে। একই স্থাপত্যশৈলির মূল মাজারের উত্তর পাশে রয়েছে তাঁর তিন সিঁড়ি নির্মিত কবর।
মাজারের সাথে রয়েছে ধর্মীয় ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে নির্মিত সুলতানী আমলের নির্মাণরীতির মিনার। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলায় হযরত শাহ মোকাররম দানেশমান্দ (রঃ) এর মাজার শরীফ। এটা ঐতিহাসিক বড়বাঘা মাজার শরীফ নামেই বেশি পরিচিত।
বাবা শাহ মোকাররম দানেশমান্দ (রঃ) তাঁর সঙ্গী কিছু আওলিয়ার সঙ্গে এই এলাকায় ইসলামের শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেন। তাঁদের সঙ্গী ছিল একটি বাঘ। সেই বাঘেরও একটি ছোট তিন সিঁড়ি নির্মিত কবর এখানে বিদ্যমান। তাছাড়া একই স্থাপত্যশৈলির কয়েকজন আওলিয়ার মাজার শরীফ আছে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, এ কারনেই স্থানটি বড়বাঘা মাজার শরীফ নামে পরিচিত। এই মহান আওলিয়ার মাজার শরীফ জিয়ারত করতে প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক স্থাপনা শাহ নেয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মাজার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী তোহাখানা কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে শাহ নেয়ামতউল্লাহ (রঃ) এর তিন গম্বুজ মসজিদের উত্তরে একই স্থাপত্যশৈলির শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রঃ) এর মাজার অবস্থিত। শাহ নেয়ামত উল্লাহ ওয়ালী ছিলেন মধ্য যুগের বিখ্যাত একজন ইসলাম প্রচারক।
উল্লেখিত তিনটি স্থানের মাজারের স্থাপত্যশৈলি ও ইতিহাস ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কেরামতি মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই সুলতান আমলের রওজা এবং মিনারের স্থাপত্যশৈলির সাথে মিল রয়েছে। এ রীতির অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে হুসেনশাহী আমলে নির্মিত মসজিদ উল্লেখ্য। বাংলার ধর্মীয় ইমারতের বিদ্যমান জ্ঞাত উদাহরণ। এসব ধর্মীয় ইমারত সুলতান ও মুঘল স্থাপত্যের প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ণয়ে যথেষ্ট সহায়ক।
ইতিহাস পর্যালোচনা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। বাঘা শাহী মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ৫০ টাকার নোটের উপরে সেই বিখ্যাত বাঘা মসজিদ।
জনশ্রুতি আছে, সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ পদ্মা নদী দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহ দমন করতে যাচ্ছিলেন। পথে তার বাহিনীর সবাই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। বাঘায় যাত্রাবিরতি দিয়ে নাসির উদ্দীন দেখেন, বাঘবেষ্টিত একজন সাধক ধ্যানে বসে আছেন। তখন তারা সাধক শাহদৌলার কাছে তাদের অসুখের কথা বলেন। পরে শাহদৌলার দেওয়া ওষুধ খেয়ে তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ সময় নাসির উদ্দীন জানতে চান, এ সময় ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে কি-না? সাধক তাদের একদিন অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর তিনি জানান, আর ঢাকায় যেতে হবে না। যুদ্ধে তারা জয়লাভ করেছেন।
একদিন পর দূত এসে জানান, সত্যিই তারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। তখন তিনি সুলতান সাধকের প্রতি অভিভূত হন এবং কিছু নিষ্কণ্টক জমি গ্রহণের অনুরোধ জানান। পার্থিব সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত সাধক শাহদৌলা তা গ্রহণ করেননি। পরে তার ছেলে আবদুল হামিদ দানিশমন্দকে (রহ.) তা প্রদান করেন। সুলতান তাকে ৪২টি মৌজার ভূমি দান করেন।
১৫২৩-১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ হজরত শাহদৌলার সম্মানে বাঘায় অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত মসজিদটি নির্মাণ করেন। দেশের পুরনো ৫০ টাকার নোটে ও ১০ টাকার ডাকটিকিটে এটি স্থান পেয়েছে।
আলােচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব ময়মনসিংহের মোমেনসিং পরগনা, পূর্বে দক্ষিনে নাসিরুর্জিয়াল পরগনা এবং দক্ষিনে হোসেনশাহী পরগনা। এই পরগনাগুলি প্রমাণ করে যে বড়বাঘা মাজার ও মসজিদ যে সময়ে নির্মিত হয়েছিলো, সে সময়ে বা তার আগে গৌরীপুরের কেরামতি মসজিদ ও মাজার নির্মিত হয়েছিলো। তাই চিত্রের সাথে মিল দেখে সে হিসেবে বলা যায় মসজিদটি যথেষ্ট প্রাচীন।
আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, বড়বাঘা মাজার, বাঘা মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাজার, শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রঃ) এর মাজারের স্থাপত্যশৈলি ও ইতিহাস ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কেরামতি মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই সুলতান আমলের রওজা এবং মিনারের স্থাপত্যশৈলির সাথে মিল রয়েছে। ৫০০ বছরের অধিক সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে আছে ঐতিহ্যবাহী কেরামতি মসজিদের সম্মুখে একই স্থাপত্যশৈলির এক ওলির মাজার।
চলবে ...
মন্তব্য করুন: