নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া দাঁড়িপাল্লা প্রতীকেই নিবন্ধন হবে কিনা সেই সিদ্ধান্তও ইসি নেবে।
রবিবার (১ জুন) সকাল ১০টার দিকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই রাই দেন।
এই মামলায় আদালতে আপিল আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক, ইমরান এ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির।
আর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলনকে জামায়াতের আন্দোলন উল্লেখ করে গত বছরের ১ আগস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে জামায়াত রাজনীতিতে আসলেও দলটির নিববন্ধন ছিল না।
দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কোনো দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলে তারা কোনো ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
নিবন্ধন বাতিল ও মামলার কার্যক্রম
২০২৪ সালের ১ আগস্ট নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়েও জামায়াত ও শিবিরকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে দায়ী করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন আর এই নামে রাজনীতি করতে পারবে না।
এর আগে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট উচ্চ আদালত জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আদালতের আদেশে ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত লিভ টু আপিল করলে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। ফলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার হারায়। তবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
এর আগেও দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দুবার নিষিদ্ধ করা হয়। জামায়াত ইসলামী প্রথম নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে পাকিস্তান আমলে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে দ্বিতীয়বার জামায়াতে ইসলামীও নিষিদ্ধ হয়। দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙার জোরালো বিরোধিতা করেছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দল হিসেবে আবার ঝুঁকির মুখে পড়ে জামায়াত। দলটিকে ইসির দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে ৫ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের ৫ বছর পর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজ করে এর আগে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। তবে আপিলকারীর পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী না থাকায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ ওই আদেশ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) দেন। পরে দেরি মার্জনা চেয়ে আপিল ও লিভ টু আপিল পুনরুজ্জীবিত চেয়ে দলটির পক্ষ থেকে পৃথক আবেদন করা হয়। আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ আবেদন মঞ্জুর (রিস্টোর) করে আদেশ দেন। জামায়াতের আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির জন্য এরপর আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে।
গত ১৪ মে শুনানি শেষে এই মামলায় রায়ের জন্য ১ জুন ধার্য করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ। নিবন্ধন আপিলের সঙ্গে একই বছর দলটির প্রতীক বরাদ্দ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে করা একটি আবেদনও একই ক্রমিকে গত ১৪ মে আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। তবে প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে করা আবেদনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা আগের দিন শুনানিতে জানান আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী।
এর আগে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে বরাদ্দ না দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (জ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে ইসির জন্য সেই দলের নিবন্ধন বাতিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নিবন্ধন প্রথা চালু করে ইসি। আর দলীয় প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে ইসির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। এ পর্যন্ত ৫৫টি দল ইসির নিবন্ধন পেলেও পরবর্তী সময়ে শর্ত পূরণ, শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামীসহ ৫টি দলের নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার করে প্রজ্ঞাপন জারির পর গত ১২ মে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
অমিয়/
এসবিডি/এবি
মন্তব্য করুন: