• ঢাকা

  •  শনিবার, জুন ২১, ২০২৫

ফিচার

গৌরীপুরের সরিষাহাটির অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য

রায়হান উদ্দিন সরকার

 প্রকাশিত: ১৭:১৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

গৌরীপুরের সরিষাহাটির অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রাচীন যুগ থেকে আজকের সরিষাহাটি যতগুলো সিঁড়ি পার করেছে, তার সব ক’টির চিহ্ন ধরে রেখেছে রেনেলের মানচিত্র। নদীর চিহ্ন, প্রাচীন মাজার তৎসংলগ্ন প্রাচীন মসজিদ, হাওড় অঞ্চলের হাটি বা টেক।

প্রথমে, রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের আবিষ্কার বদলে দিতে পারে সরিষাহাটি গ্রামের অতীত ইতিহাস। সরিষাহাটি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার সহনাটি ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। এই গ্রামটি গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে, রামপুর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং  বেখৈরহাটি থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত।

এককালের ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখানদী ও উপনদীর বেষ্টনে অধূনা খ্যাত ভাটি অঞ্চলের হাটি, গ্রাম বা পাড়া প্রভৃতির বিপুল জলরাশির কল্যানে  বেখৈরহাটি, মহিষহাটি, পাজুহাটি, স্বল্পনওহাটি, বাংগুরীহাটি, বাশাটির কোলে হাওড় অঞ্চলের এক সমৃদ্ধ জনপথ সরিষাহাটি।

হাওড় অঞ্চলে দ্বীপ আকৃতির উচু ভূমি বা গ্রামকে হাটি বলা হয়। সরিষাহাটি সে সময় সরিষা তেল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত নৌবন্দর হিসাবে খ্যাত ছিল। কয়েক দশক আগেও সরিষার তেল ছিল বাংলাদেশে রান্নায় বহুল ব্যবহৃত ভোজ্যতেল। ধারণা করা হচ্ছে, এ এলাকায় বহুদিন আগে ঘানি দিয়ে সরিষা থেকে তেল করা হতো। তাই গ্রামের নাম সরিষাহাটি।

গ্রামের পূর্বে পাটেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল সরলভাগ্যান্বেষী, মৎস্যজীবী, শরণার্থী, বনের নানা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়  ও আদিবাসীদের মিশ্রিত জনসমাজ। রেনেলের মানচিত্রে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রসস্ততা ১৫  থেকে ২০ কিলোমিটার এবং জমিদার শ্রী সৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১১২ বছর আগে প্রকাশিত একটি ফিচার ’বোকাইনগরের ইতিবৃত্ত’ এর  রেফারেন্সে রাজগঞ্জ (সাহেব কাচারী) পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে দেখেছে কয়েকজন শতবর্ষী ব্যক্তি। অর্থাৎ ১৭৮৭ সালের আগে রাজগঞ্জ পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্থততা ছিলো বর্তমান বাংলাদেশের প্রবেশ মূখে অর্থাৎ কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের মতো।

১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ এবং কিছু জায়গা উঠিত হবার কারণে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে একটি যমুনা নদী সৃষ্টি হয় এবং পদ্মার সাথে মিলিত হয়। পর্যাক্রমে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ৮৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে ময়মনসিংহ অঞ্চলের শাখা নদীগুলো খাল বিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু নদীমাতৃক সেই হাওড়বেষ্টিত কয়েকশ' বছরের নিদর্শন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পট পরিবর্তনের কারণে পলিমাটির তলায় লুপ্ত হয়েছে।

এ তথ্য থেকে জানা যায়, গৌরীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে ছিলো এক বিশাল হাওড় অঞ্চল। গৌরীপুর ও তৎসংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণের কোন প্রামাণ্য দলিল অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। তা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির উপর ভিত্তিকরে গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন প্রাচীন এলাকার নামকরণের ইতিহাস তুলে ধরা হলো।

কেদারনাথ মজুমদারের ’ময়মনসিংহ বিবরণ’ বই  থেকে জানা যায় ’পালিত মহিষ বড় বড় হাওড়ে পালিত হয়।’ তাই মহিষহাটি নামকরণে প্রাচীনকালে এ গ্রামের চারদিকে হাওর অঞ্চল ছিল বলে খুব সহজে চিহ্নিত করা যায়। এই হাটিতে অনেক মহিষ পালন করা হতো। তাই গ্রামের নাম মহিষহাটি। ঠিক তেমনি বাশাঁটি নামকরণে বাশেঁর জন্য যে হাটি বিখ্যাত ছিল, তাই গ্রামের নাম বাশাঁটি। 

হাওড়বাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ভাটি অঞ্চলে শস্যক্ষেত থেকে অনেক উচুভূমিতে বসবাসের জন্য যে পাড়া বা গ্রাম গঠিত হয় সে জায়গাকে হাওড়বাসী ’হাটি’ বলে। বানিয়াচং নিবাসী সুপ্তা দাস বলেন, হাওড় এলাকায় গ্রামের অধিকাংশ শস্যক্ষেত বর্ষাকালে ডুবে থাকে দশ থেকে পনের ফুট পানির নিচে।

ঐ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রমাণিত হয়েছে যে, পূর্ব ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার হাওড় অঞ্চল আড়াইশ' বছর আগেও অস্তিত্ব ছিলো। এই আবিষ্কারের ফলে গৌরীপুর উপজেলার পূর্ব অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে অনেক ধারণা। অদূর ভবিষ্যতে নতুন করে লিখতে হবে ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস।

পাটেশ্বরী নদীর তীরে সরিষাহাটির চরপাড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূমি গৌরীপুর উপজেলার এক ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় পাটেশ্বরী। যেখানে নদী ছিল, সেখানে বর্তমানে খাল-বিল, সরিষাহাটি গ্রামের নৌবন্দরে এখন আর নোঙর করেনা সওদাগরের সপ্তডিংগা ও বড় বড় নৌকা, পালতুলে ছুটে আসে না বণিকের দল। বৈচিত্রময় জলপ্রবাহের অস্তিত্ব আর নেই। পাটেশ্বরী নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত কেন্দুয়া উপজেলার সীমানা ও বাঁশাটি গ্রাম। নদীর ধারে প্রাচীন গাছ ও জঙ্গল অতীত দিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে দিচ্ছে। কালের সাক্ষী খাল-বিলকে যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করলে হয়তো আরও কয়েক দশক নদীর স্মৃতির ঐতিহ্য ধরে রাখা যাবে। তাছাড়া, রেনেলের মানচিত্র দেখে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে তখনকার দিনের বিখ্যাত সরিষাহাটি ও পাটেশ্বরী নদী। সরিষাহাটির পাটেশ্বরী নদী পর্যটকদের কাছে চিত্তাকর্ষক হতে পারে। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরিষাহাটি ও তৎসংলগ গ্রামে তিন-চারটি প্রাচীন মাজার এবং পাঠান ও মুঘল আমলের মসজিদের অস্তিত্ব ছিলো। তা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তির উপর ভিত্তিকরে বিভিন্ন প্রাচীন মাজার এবং মসজিদের বিবরণ ও ইতিহাস তুলে ধরা হলো। 

রাইশিমুল ফকির বাড়িতে আধ্যাত্মিক জগতের সুফি সাধকের মাজার: 
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সহনাটী ইউনিয়নের রাইশিমুল ফকির বাড়িতে শত শত বছর ধরে পীর পাল হযরত শাহ্ সূফি খাতিম মুন্সী (রা.) এর মাজার। রাইশিমুল গ্রামটি গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে, সরিষাহাটি গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই মাজার থেকে ঠিক ১০০ গজ পশ্চিম পাশেই বেশ পুরানো মসজিদ ছিলো। পাঠান বা মুঘল আমলেন গঠনশৈলিতে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। এক গম্বুজ বিশিষ্ট পুরাতন মসজিদটি ভেঙ্গে নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। সুফি সাধক পীর আউলিয়ার মাধ্যমেই এই এলাকায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার হয়েছে। জানা যায়, হযরত শাহ্ সূফি খাতিম মুন্সী (রা.) মোমেনসিং পরগনার সরিষাহাটিতে এসেছিলেন ১১০০ খৃষ্টাব্দের পরে।

মাজারটির নাম পীরপাল হলো কেন ? এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। জানা গেছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য সুলতানী আমল থেকেই সরকারিভাবে নানা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বা ভূমিদান করা হতো খরচ নির্বাহের জন্য। একে বলা হতো পীরপাল লাখেরাজ। লাখেরাজ আরবি শব্দ, এর অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিলো, লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি।

১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে সুফি-দরবেশ, আলেম-উলামাদের যেসব লাখেরাজ জমি ছিলো, অধিকাংশ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত জমিদারদেরকে দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে বুঝা যায়, পশ্চিমপাশে পুরানো মসজিদটি এই মাজারের অন্তর্গত ছিলো। ধারনা করা হচ্ছে, সুলতান আমলে এই মাজারের নামে পীরপাল দানের যে সনদ পাঠানো হয়েছিলো, ইংরেজ আমলে পীরপাল দানের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ জমির পরিমান কমানো হয়েছিলো। বর্তমান এই মাজারের নামে ইংরেজ কর্তৃক পীরপাল দানের ২৭০ শতাংশ জমি রয়েছে। ঐতিহাসিক মাজারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদিমও থাকেন; অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন। লাখেরাজ বা পীরপাল দানের জমিতে কোনো বাড়ি তৈরি হলে, তখন বাড়িটিকে ফকিরবাড়ি বলা হয়। উত্তরাধিকারসূত্রে এই বাড়ির প্রত্যেক সদস্য ফকির উপাধি লাভ করেন।

তবে মাজারটি যে অতি পুরাতন সুলতান বা পাঠান অথবা মুঘল বা নবাবী আমলের কাঠ গোলাপ গাছটি প্রমাণ করে। এই গাছের বয়স কেউ বলতে পারে না। গাছের ডালপালা কাটলে অনেকের অসুখ-বিসুখ হয়। 

জরিপকালে দেখা যায়, প্রাচীনকালে যেসব মাজার রয়েছে তার পাশে কমপক্ষে একটি করে কাঠ গোলাপ গাছ রয়েছে বা ছিলো। অনেকে এই ফুলকে কাঠচাঁপা, গুলাচ, গুলাচি চাপা, ইত্যাদি নামে চেনে। ধারণা করা হয় পুর্তুগিজরাই সর্বপ্রথম এই ফুল এ দেশে নিয়ে আসে। কিন্তু ইন্ডিয়াতে আবার এই ফুলকে ‘কৃষ্ণ’র ফুল হিসেবে দেখা হয়। তাই, এই ফুলের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। কাঠগোলাপের নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। নারকেল তেলের সঙ্গে এর কষ চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এর ফুল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র, পূজার উপকরণ এবং বৌদ্ধরা ভাবে, এটি মৃত্যুহীন প্রাণের প্রতীক।

ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ মাজার নিয়ে কথা হয়। স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে প্রাচীন মাজারের কথা শুনে আসছেন। ফকির বাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আফতাব মৌলভী (৯০) বলেন, পীর পাল হযরত শাহ্ সূফি খাতিম মুন্সী (রা.) দেশের চিশতিয়া তরিকার মধ্যে একজন সূফি সাধক। এ মাজারের নামে পীরপাল দানের ২৭০ শতাংশ জমি রয়েছে। কয়েক বছর আগে ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে এ মাজারের অবস্থান ছিল। ঝোপঝার পরিষ্কার করে, মাজারের উপর একটি চৌচালা ঘর তৈরী করা হয়। ঝড় বৃষ্টি অর্থাৎ কালের পরিবর্তনে কয়েকশ' বছরের পাকা ছাড়া সাধারণ কবর কয়েক ফুট মাটির নীচে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু অলৌলিকভাবে এই সূফি সাধকের মাটির রওযা সব সময় উচু থাকে। মাজারের উপর দুইটি পাথর রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে কোন এক সময়ে পাথরের উপর মোমবাতি জ্বালানো হতো। 

মাজার নিয়ে আরও রয়েছে অলৌলিক ঘটনার কথা ও জনশ্রুতি। সমাজসেবা চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত ঈশাক ফকির (৭৩) বলেন, তার বাবা আহমেদ আলী ফকির কাছ খেকে শুনে আসছিলেন যে, অনেকদিন আগে কলেরা মহামারির হুমকিতে ফকির বাড়িতে ১৮জন রোগে আক্রান্ত  হয়। আলামত হিসেবে তখন মাজারের কাঠ গোলাপ গাছটিতে ১৮টি বেগুন ধরেছিল। পর্যাক্রমে গাছ থেকে বেগুন পড়ার সাথে সাথে ধারাবাহিকভাবে ঝরে গেছে পরিবারের ১৮টি প্রাণ।

মাজারের আধ্যাতিক কিছু তথ্য বর্ণনা করেছেন এই গ্রামের বাসিন্দা তসলিম ফকির (৩৫)। তিনি বলেন, ৭/৮ বছর আগে আবুচান নামে এক প্রতিবেশী মাজারের আশপাশ ও বাঁশঝাড় থেকে ১০০/১৫০টি বাশঁ কাটার সময়ে মাজারের কাঠগোলাপ গাছের একটি ডাল কাঠার পর পেটে ব্যাথা শুরু হয় এবং তিলে তিলে অনেক ভোগান্তির পর দেড় বছরের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি আরও বলেন, মিন্টু নামে এক ব্যক্তি ঝোক করে মাজারের একটি পাথর অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিল এবং পরের দিন দেখেছেন পাথরটি পুনরায় মাজারে চলে এসেছে। পাথরটি কিভাবে মাজারে চলে আসলো তা মিন্টু জেনে অবাক হলেন।

কালের সাক্ষী এ পীরপাল মাজারটি যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করলে শত শত বছর আগের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পাঠান, মুঘল, সুলতান আমলের স্মৃতির ঐতিহ্য ধরে রাখা যাবে। এক সময়ে গ্রামটি হাওরের মধ্যে ও একটি নদীর উপর অবস্থিত ছিল।

গিডাউষাঁ গ্রামে এক ওলির মাজার:
ময়মনিসংহের গৌরীপুর উপেজলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে গিডাউষাঁ  গ্রামে অবস্থিত কয়েক শত বছরের পুরনো শাহ মোকরম (রহ.) এর মাজার। সংক্ষিপ্ত আকারে এই আধ্যাত্মিক দরগা সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হলো।

এক সময়ে গ্রামটি একটি নদীর বা হাওরের টেক বা হাটির উপর অবস্থিত ছিল। এই হাটির সংলগ্ন ছিল সরিষাহাটি। ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, হাজার বছর আগে এখানে অসভ্য জাতি বসবাস করতো। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী লিখেছেন মোমেনসিং পরগনায় কোচ মেচ জাতির বসবাস অধিক ছিলো। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কামরূপ শাসনের অবসান হলে মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করেন। বিশেষত কামরূপকে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং ভুটানের পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত বলে মনে করতো, যাদু, যোজনা এবং যাদুবিদ্যার বিশেষজ্ঞ অনুশীলনকারীদের দ্বারা বাস করা এক কল্পিত এবং রহস্যময় স্থান।

সিলেট সফরকালে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছিলেন, 'এই পাহাড়ের বাসিন্দারা যাদু এবং জাদুবিদ্যার প্রতি তাদের অনুরাগী অনুশীলন এবং অনুশীলনের জন্য খ্যাত।' এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর, আউলিয়া, ফকির ও দরবেশদের বদৌলতে। মুসলিম শাসকরা যখনই কোনো  অঞ্চল বা স্থান জয় করেছেন, তখনই তারা সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
 
দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে অজস্র অজানা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। কোনোটা প্রকাশিত হচ্ছে, আর কোনোটা হচ্ছে না। সেই সব ঐতিহাসিক নিদর্শনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি লুকায়িত অনেক ঘটনা। তেমনি একটি নিদর্শন এক ওলির মাজার। ইসলাম প্রচার করার জন্য হযরত শাহ মোকরম (রহ.) নামে কোন এক সুফি সাধক এসেছিলেন । তিনি বহু কোচ মেচ জাতিকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তাছাড়া কোচ, হাজং, গারো প্রভৃতি জাতিকে নতুন সভ্যাতালোকে আনায়ন করেছিলেন।

জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ মাজার নিয়ে কথা হয়। স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে প্রাচীন মাজারের কথা শুনে আসছেন। আহমদ আলী ফকির (৭০) বলেন, হযরত শাহ মোকরম (রহ.) দেশের চিশতিয়া তরিকার মধ্যে একজন সূফি সাধক। আগে এই মাজারের নামে পীরপাল বা লাখেরাজ দানের কতটুকু জমি ছিল তা তিনি জানে না। তবে বর্তমানে মাজারের নামে ৩৯ শতাংশ জমি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বহুদিন আগে মাজারের পশ্চিমপাশে মুঘল আমলের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ছিল এবং মাজারের সাথে ছিল একটি কাঠ গোলাপ গাছ। কালের সাক্ষী এ প্রাচীন মাজারটি যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

বাঁশাটী গ্রামে হযরত শাহ্ শেখ ইয়াহিয়া (রহ.) এর মাজার:
পাটেশ্বরী নদীর পূর্ব তীরে বাশাঁটি গ্রাম। বাশাঁটি নামকরণে বাশেঁর জন্য যে হাটি বিখ্যাত ছিল, তাই গ্রামের নাম বাশাঁটি। গৌরীপুর উপজেলার সরিষাহাটির তৎসংলগ কেন্দুয়া উপজেলার বাশাঁটি গ্রামটি হযরত শাহ্ শেখ ইয়াহিয়া (রহ:) এর মাজারের জন্য বিখ্যাত। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আগত ইসলাম প্রচারক আওলিয়া-দরবেশদের মাজারগুলি বিদ্যমান, তাদের মধ্যে একটি। বিস্তৃত ইতিহাস-ঐতিহ্যের অধিকারী এ মাজারে রয়েছে গৌরবময় অতীত, সমৃদ্ধ বর্তমান ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।

<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="400" src="//www.youtube.com/embed/4OYGaHqwqnw" width="725"></iframe>

মাজার বলতে সাধারণত আওলিয়া-দরবেশদের সমাধিস্থলকে বোঝায়। মাজারকে রওযা বা কবরও বলা হয়। এর নিকটবর্তী স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ইত্যাদি গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক মাজারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদেমও থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন। অসভ্য কোচ, হাজং, গারো প্রভৃতি জাতির রাজত্বকালে হযরত শাহ্ শেখ ইয়াহিয়া (রহ:) ধর্ম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে আগমন করেন। এই সুফি দরবেশ সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে খরস্রোতা পাটেশ্বরী নদীর তীরে আস্থানা স্থাপন করেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এই পীরের মাজারে প্রতিবছর ভক্তরা সমবেত হয়ে ওরস করেন। এখানে প্রতিদিন অনেক ভক্ত জিয়ারত ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মান্নত দিতে আসেন।

জরিপকালীন সময়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ মাজার নিয়ে কথা হয়। স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে প্রাচীন মাজারের কথা শুনে আসছেন। মো. মুজিবুর রহমান (৫০) বলেন,  এ মাজারের নামে পীরপাল দানের সনদপ্রাপ্ত হয়েছিল কিনা অথবা লাখেরাজ দানের কতটুকু জমি ছিল তা তিনি জানে না। তবে ১৯১০-১২ সালে সিএস (১৮৮৮-১৯৪০) ভূমি জরিপ করার সময়ে মাজারের নামে ৫১৮ শতাংশ জমি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই মাজার থেকে ঠিক ১৫০ গজ পূর্ব পাশেই বেশ পুরানো মসজিদ ছিলো। পাঠান বা মুঘল আমলেন গঠনশৈলিতে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। একগম্বুজ বিশিষ্ট পুরাতন মসজিদটি ভেঙ্গে নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে।

জরিপ কমিটির মতে, এ প্রাচীন জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রচনা করা অত্যন্ত জটিল, সময় সাপেক্ষ এবং প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। কোন কিছুর ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকলে, তথ্যের আপডেট চলমান থাকবে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য মানুষের অতীত ঘটনাবলী সঠিক পর্যালোচনা করে। যার উপর ভিত্তিকরে মানুষ বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজেদেরকে গড়ে তুলে সুসভ্য জাতি হিসেবে। সে হিসেবে এ অঞ্চল অতীত আর গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যে মোমেনসিং পরগনা।  

প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়ের স্বল্প পরিসরে হলেও মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে গৌরীপুর উপজেলায় অবস্থিত সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন, এসিক এসোসিয়েশন এবং ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। গবেষণার ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত প্রতিবেদক নিজে মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার (সংগঠক, সাংবাদিক, গবেষক, প্রত্নতথ্য-সংগ্রহকারী)। তাই, খুজে পাওয়া গেছে ময়মনসিংহের শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য। তাছাড়া মাজারগুলি কালেরসাক্ষী হয়ে, নদ-নদীর বিশালতা হারিয়ে, হাওড় অঞ্চলের অতীত দিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে দিচ্ছে।

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১

মন্তব্য করুন: