• ঢাকা

  •  শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ফিচার

ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী আদমদিঘির কড়ই রাজবাড়ি

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার

 আপডেট: ২২:২০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী আদমদিঘির কড়ই রাজবাড়ি

বগুড়ার আদমাদিঘির কড়ই স্থানীয় ও জাতীয় ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়।আদমদিঘি উপজেলার কুন্দগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ রাজবাড়িটি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কড়ই জমিদারবাড়ি হিসাবেও সুপরিচিত। ইতিহাস আর ঐতিহ্যেঘেরা কড়ই (করৈ) গ্রামে রয়েছে প্রাচীন সব নিদর্শন। আর রয়েছে তৎকালীন ব্রাহ্মণ রাজা-জমিদারদের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

ব্রাহ্মণ জমিদার যজ্ঞেশ্বর ও জয়নারায়ণ দুই ভাই পারস্য ভাষায় শিক্ষালাভ করে নবাব সরকারের কর্মলাভ করেন।তাদের দক্ষতা, কর্তব্য ও প্রতিভার গুণে নবাবের প্রিয়পাত্র হয়ে "তলাপাত্র" উপাধি লাভ করেন।নবাবের অনুগ্রহে তরফ করৈ শেলবর্ষ ও ছিন্দাবাজু পরগনার অন্তর্গত ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে নাটোর থেকে বগুড়ার আদমদিঘির কড়ই (করৈ) গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন।এই সম্পত্তি পূর্বে সৈয়দ আলী চৌধুরী নামক এক মুসলমান জমিদারের অধিকারে ছিল।কালক্রমে উক্ত সৈয়দ আলী চৌধুরীর কোনো বংশধর না থাকায় ঐ জমিদারি নবাব সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।তারপর যজ্ঞেশ্বর ও জয়নারায়ণ তলাপাত্র নবাব সরকারের উপযুক্ত নজরাদি দিয়ে ওই জমিদারির মালিক হন।

জ্যেষ্ঠ যজ্ঞেশ্বর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।কনিষ্ঠ জয়নারায়ণ তলাপাত্রের ঔরসে তিলোতমা দেবীর গর্ভে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন।উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গৌরীপুরের রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার জীবদ্দশায় কড়ই গ্রামে তৎকালীন জমিদারদের সুবৃহৎ বাসভবনের ভগ্নাবশেষ বিপুল সমৃদ্ধির পরিচয় দিচ্ছিল।জয়নারায়ণ তলাপাত্রের একমাত্র পুত্রসন্তান শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সময়ে এই বাসভবনের একাধিক উন্নতি সাধিত হয়েছিল।জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে কড়ই (করৈ) রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে।কড়ই রাজবাড়ি সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো - 

‘‘ঐ বাসভবনটি অতি বৃহৎ, চতুর্দিকে পরিখাপরি বেষ্টিত।কালের কঠোর হস্তে ইহার পূর্বের শোভা সৌন্দর্য সমস্ত বিনষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু এখনও যাহা আছে তাহাতেই শিল্পপ্রিয় ব্যক্তিগণের হৃদয় মুগ্ধ হইতে পারে।দুইশত বা আড়াইশত বৎসর পূর্বে আমাদের দেশে স্থপতিকার্য কিরূপ নিপুণতার সহিত সম্পন্ন হইত উক্ত বাসভবন দৃষ্টে তাহা বিশেষ রূপে উপলব্ধি হয়।চতুর্দিকে বিস্তৃত পরিখা ও তাহার পার্শ্বে সুদৃঢ় প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ এখনও যাহা বর্তমান আছে তাহা দেখিলে ইহা যে বহিঃশত্রুর দুষ্প্রবেশ্য দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত ছিল তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়।’’

রেনেলের মানচিত্রে আদমদিঘি ও কড়ই (করৈ>কড়রি):
বাংলার মানচিত্রের পথিকৃৎ মেজর জেমস রেনেল। জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্র বাংলার প্রাচীন মানচিত্র।বাংলাদেশে ইতিহাস বিভাগে  “Rennells Bengals Atlas” এই বিশাল মানচিত্র একসময়ে দুষ্প্রাপ্য ছিল।শত শত বছরের প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে আদমদিঘি ও কড়ই গ্রামে।এ রকম প্রাচীন ও সুস্পষ্ট ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ময়মনসিংহের গৌরীপুরে অবস্থিত ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি ও লাইব্রেরি এবং দিইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স নামে সংগঠনগুলো কাজ করছে।সংগঠনের মাধ্যমে অজানাকে জানার জন্য ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায়, তথ্যসূত্র, জনশ্রুতি, প্রাচীন মানুষের কথা, ঝরেপড়া অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ, প্রাচীন দুর্লভ তথ্য ও প্রাচীন মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে আপডেট ইতিহাস রচনা করা হয় বা হয়ে থাকে।

প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এসিক এসোসিয়েশন ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রতিবছর একটি স্বনামধন্য আঞ্চলিক তথ্যবহুল ম্যাগাজিন ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’প্রকাশিত হয়।ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রেনেলের আড়াইশত বছর আগের কয়েকটি মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, তৎকালীন বগুড়ার এলাকার দিকে দৃষ্টি দিলে আদমদিঘি এবং কড়রি নামে প্রাচীন জনপদ বা প্রসিদ্ধ স্থানের নাম পাওয়া যায়।কড়ই পূর্বে করৈ বা কড়রি উচ্চারণ করা হতো বলে জানা যায়। আজকাল কড়ইয়ের অবস্থা দেখলে তা ভাবতেও কষ্ট হয়।

করৈ রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে কড়ইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাচীন দালানের কথা উল্লেখ করেছেন।যেমন -

ক) বারোদুয়ারী ভগ্ন দালান:
রাজবাড়ির মধ্যে অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য পূর্ণ বারদুয়ারী নামক যে এক বৃহৎ অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ ছিল তাহা দৈর্ঘে ছিল প্রায় দেড়শত ফুট। যে সকল খিলান তখনও বিদ্যমান ছিল তাহা বিশেষ সুপ্রণালী বিনির্মিত এবং সুদৃঢ়।দেওয়ালের ভিতরে ও বাহিরে খোপকাটা, ইস্টকগুলির কারুকার্য দর্শকের চিত্তাকর্ষক।তৃণগুল্মের অত্যাচারে এই প্রাচীন কীর্তি ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হতে ছিল, ছাদ ভেঙ্গে পড়িয়াছিল, দেওয়ালগুলো ফাটিয়া গিয়েছিল।

খ) কালাচাঁদের মন্দির:
এই রাজবাড়িতে কালাচাঁদ নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।কোন ব্যক্তি কর্তৃক মন্দির নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলার কোনো উপায় ছিল না। মন্দিরের বাহিরের এক স্থানে ১৭১৬ (বাংলা ১১২২) সনে মন্দির নির্মিত হয়েছিল বলে লেখা ছিল। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যে, জয়নারায়ণ তলাপাত্রের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী কর্তৃক মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

কালাচাঁদের মন্দিরের সম্মুখে একটি চকমেলান দালানের ধ্বংসচিহ্ন সে সময়ে ছিল।ঐ চকমেলান দালানের দুই একটি প্রকোষ্ঠ তখনও থাকার জন্য উপযোগী ছিল।মন্দিরটি ও চকমেলান দালানের রচনাপ্রণালী বড়ই সুন্দর ও সুদৃঢ়।বাংলা ১২৯২ সনের ভূমিকম্পের পর হতে দেব বিগ্রহ কালাচাঁদ মন্দির ছেড়ে রাজবাড়ির বাইরে একটি ঘরে পূজা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেই স্থানেই রীতিমতো সেবা চলতেছিল।কালাচাঁদ মন্দিরের সম্মুখে অর্থাৎ চকমেলান দালানের ভিতরে যে প্রাঙ্গন আছে ইহা দেখলে প্রতীয়মান হয় যে এই স্থানে সময় সময় নাট্যাভিনয় হতো।

গ) দুর্গামণ্ডপ ও ভোগদালান:
কালাচাঁদ মন্দিরের দক্ষিণে দুর্গামণ্ডপ ও পার্শ্বে ভোগগৃহের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।দুর্গামণ্ডপের প্রাচীন প্রথানুযায়ী খোদাইকার্যের অপূর্ব শিল্পচাতুর্য দেখলে অবাক হওয়ার মতো ছিল।দুর্গামণ্ডপের অধিকাংশ ভূমিকম্পে পতিত হয়ে গিয়েছিল। যে অংশ তখন দণ্ডায়মান ছিল তাতে শিল্প নৈপুণ্যের অপূর্ব নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।

ঘ) শিবমন্দির:
রাজবাড়িতে একটি সুন্দর শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরটি যে কার কীর্তি, কেও বলতে পারে না।মন্দিরটি ভগ্ন ও বৃক্ষলতায় সমাচ্ছন্ন ছিলো। ইহার গঠন-পারিপাট্য ও শিল্পনৈপুণ্য অতি সুন্দর ছিল। যদিও ইহা ফাটিয়া ছিল, ভাঙিয়াছিল এবং এর কতক অংশ ভূমিসাৎ হয়েছিল, তথাপি ভগ্নখণ্ডের একখানি ইষ্টক ও স্থানচ্যুত হয় নাই।চুণে ইষ্টক মিলিয়ে জমাট বান্ধিয়ে সুকঠিন প্রস্তরখণ্ডের মত খণ্ড খণ্ড ভাবে পড়িয়ে কালের সর্বনাশিনী কীর্তির মাহাত্ম্য প্রকটিত করতেছিল। দেওয়ালের উপরিভাগে এক স্থানে কারুকার্যেরও চিহ্ন দেখা গিয়েছিল।

ঙ) অন্তঃপুরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
অন্তঃপুরে অনেকগুলি অট্টালিকার ধ্বংসচিহ্ন তখনও ছিল।স্থানে স্থানে ইটের স্তূপ, স্থানে স্থানে ভগ্ন প্রাচীর, স্থানে স্থানে কারুকার্যপূর্ণ প্রাচীরের ভগ্নাংশ দেখলে এই অন্তঃপুর যে কিরূপ সুবিশাল ও বহু সৌধমালায় অলঙ্কৃত ছিল তাহা স্পষ্টই অনুমিত হয়েছিল।অন্তঃপুরে প্রবেশ করবার পথে একটি তোরণ দ্বারের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল।মনে হয় এককালে অস্ত্রধারী প্রহরীগণ এই স্থানে দণ্ডায়মান হয়ে প্রহরায় নিযুক্ত থাকতো।

চ) অন্তঃপুরের দ্বিতল দালান:
একশত বছর আগেও অন্তঃপুরে সে সময়ের একটি দ্বিতল প্রাসাদ ছিল। ইহার নিচতলের অবস্থা অনেকটা ভাল ছিল।নিচতলার একটি ছোট কুঠুরির মধ্যে সুড়ঙ্গের মত গর্ভের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। সে সময়ের স্থানীয় লোকেরা বলত যে, এই সুড়ঙ্গপথে অনেকদিন ধনাগার ছিল।এই স্থান হতে ধন-দৌলত লাভ করবার জন্য অনেক সময় গরীব লোকেরা মাটি খনন করত। পিতলের অট্টালিকার প্রাচীরগুলি তখনও অনেকটা দণ্ডায়মান ছিল।প্রাসাদটি খুব শক্ত ছিল। ঝড় বজ্রাঘাত ও ভূমিকম্পের ভীষণ বেগ সহ্য করে এবং সর্বশক্তিমান কালের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখনও এটি দণ্ডায়মান ছিল। ইহার নিচতলায় প্রাচীরের উচ্চ স্থানে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বা ফাঁক ছিল।ঐ ছিদ্রপথে অল্প পরিমাণ আলোক ও বায়ুর সমাগম হতে পারত। কি কারণে ঐ প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল তা কেউ জানত না।তখন বোধ হয়েছিল এটা ধনাগার কিম্বা কারাগারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল।

ছ) কালীমন্দির সম্বন্ধীয় কিংবদন্তী:
এই প্রাসাদের সামান্য দূরে একটি মন্দির ছিল। ঐ মন্দিরে কোনও দেবমূর্তি ছিল না।কোন বিগ্রহ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা জানার উপায় ছিল না। জনশ্রুতিতে এখানে একটি কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।কিংবদন্তী এইরূপ ছিল যে, কোনও গুরুতর অপরাধীকে বিশেষরূপে দণ্ডিত করবার জন্য এই স্থানে আনয়ন করে কালীর সামনে বলিদান করা হত। মন্দিরটি মজবুত ও বহু পুরাতন ছিল।কালের আবর্তনে ইহার কিছু অংশ ভেঙ্গে মাটির মধ্যে পড়ে থাকায় দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ভিতরে প্রবেশের পথ ছিলনা, ভিতরের শিল্পকার্য জানবার উপায় ছিলনা।

জ) অন্দরমহল বা অন্তঃপুরটি দুই ভাগে বিভক্ত:
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দুই পত্নীর বাসের জন্য অন্দরমহলটি দুই অংশে বিভক্ত হয়েছিল।অন্তঃপুরে অনেকগুলি লোকালয়ের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।

ঝ) সুড়ঙ্গ সম্বন্ধে প্রবাদ:
রাজবাড়ির মধ্যে এক স্থানে একটি সুড়ঙ্গপথ দেখা গিয়েছিল। ঐ স্থানে তা ইট ও মৃত্তিকা দ্বারা বন্ধ ছিল।কিন্তু এক সময়ে ঐ সুড়ঙ্গপথে যে কোনও গুপ্তস্থানে গমনাগমন করা যেত তা সন্দেহমাত্র ছিলনা।জনশ্রুতি অনুসারে জানা গিয়েছিল যে, ঐ সুড়ঙ্গমধ্যে অস্ত্রশস্ত্রাদি লুক্কায়িত থাকত।অস্ত্রাগার বা ধনাগার অথবা তদ্রুপ কোনও বিশেষ প্রয়োজনীয় গুপ্তগৃহ ঐ সুড়ঙ্গ শেষে যে সংস্থাপিত ছিল, তাই অনুমান হয়েছিল। এই পরিখাবেষ্টিত, শক্ত প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত অগণ্য অট্টালিকাশ্রেণিতে পরিপূর্ণ, দেবালয়, উৎসবালয়, কারাগার ও অস্ত্রাগার দ্বারা সজ্জিত সুবিশাল রাজবাড়ির অধিকারী কিরূপ ক্ষমতাশালী ও ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন তা সহজেই অনুমিত হতে পারা যেত।সে সময়ের অতীত গৌরবের ক্ষীণ চিহ্নগুলি যা দেখা গিয়েছিল বর্তমানে থাকলে তা দেশের হেরিটেজ ছিল।

ঞ) কড়ই রাজবাড়ি সম্বন্ধে একটি প্রবাদ:
কড়ই রাজবাড়ির সম্বন্ধে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল যে, এই বাড়ির মধ্যে একটি মালখানা (ধনাগার) আছে এবং তথায় প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে আছে।এই জনশ্রুতিতে বিশ্বাস করে সে সময়ে কৃষকগণ তখনও স্থানে স্থানে খনন করে ধন-রত্নের অনুসন্ধান করে থাকত। সে সময়ের করৈর জমিদারগণ যখন এই স্থান পরিত্যাগ করে গিয়েছিলেন, তখন পথে দস্যুর আশঙ্কা করে ধন-রত্নাদি সঙ্গে লয়ে যাত্রা করে নাই।অধিকাংশ ধন এই রাজবাড়িতেই কোনও গুপ্তস্থানে লুক্কায়িত করে গিয়েছিল। কোন কারণে তারা আর এই বাড়িতে ফিরে আসে নাই।এই প্রবাদ বাক্যটি যে কতদূর বিশ্বাস্য ছিল তা সহজেই বুঝা যেত।কিন্তু ধনের আশা ও অতৃপ্ত লালসা যখন জ্ঞানী মানুষকেও অন্ধ পথে পরিচালন করে থাকে তখন নিরক্ষর কৃষকের অপরাধ কি?

ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায় এবং বর্তমান (২০২৩ সাল) কড়ই গ্রাম ও স্থানীয় লোকদের অনলাইনে মতামত:

আজকাল কড়ই অবস্থা দেখলে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। একশত বছর আগে কড়ই রাজবাড়ির ইতিবৃত্ত যেভাবে বর্নানা করা হয়েছে, বর্তমান রাজবাড়ির ৭০ বা ৮০ ভাগ অংশ নেই বললেই চলে। কড়ই দক্ষিণপাড়া সার্বজনীন দুর্গামন্দিরের সভাপতি শ্রী অসীম প্রামণিক বলেন, কড়ই জমিদারবাড়ি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। এখানে দু'টি মঠ ও জমিদার বাড়ির কিছু প্রাচীর রয়েছে।

কড়ই পশ্চিমপাড়া সার্বজনীন দুর্গামন্দিরের সভাপতি শ্রী গৌরাঙ্গ দেবনাথ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ চেীধুরীর পরবর্তী বংশধর গৌরীপুর জমিদারদের নাম তাদের কাগজপত্রে রয়েছে। যেমন কালীপুর জমিদার বংশের ধরণীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, স্ত্রী রামরঙ্গিনী দেবী, ছেলে নরেন্দ্রকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, নরেন্দ্রকান্ত লাহিড়ীর ছেলে ধীরেন্দ্রকান্ত (ডি কে) লাহিড়ী চৌধুরী, গোলকপুর জমিদার বংশের রাজা হরিশচন্দ্র চৌধুরী তার দত্তক পুত্র কুমার উপেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী পুত্রবধু ইন্দ্রবালা দেবী, ভবানীপুর জমিদার বংশের গিরিশ চন্দ্র চৌধুরী ছেলে (দত্তক পুত্র) রায়বাহাদুর সতীশ চন্দ্র চৌধুরী তার ছেলে বাবু যতীশ চন্দ্র চৌধুরী রায়বাহাদুর ও বাবু প্রিতীশ চন্দ্র চৌধুরী রায়বাহাদুর ইত্যাদি।

তিনি আরো বলেন, কড়ই রাজবাড়ির বর্হিঃশত্রু আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রাজবাড়ির প্রাচীরের সাথে খাল নির্মাণ করেন। অনেকদিন আগে প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে পুকুর, বাগান, প্রাসাদ পর্যন্ত জমিদার বাড়ির পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিল প্রাচীন আবহ আর ইতিহাসের ছোঁয়া। শিশু-কিশোর ও তরুণরা ইতিহাস জানতে এখানে আসতে পারেন।

শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বিদ্রোহ দমন ও ময়মনসিংহ (মোমেসিং) পরগনা প্রাপ্তি:

শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ বলবান ছিলেন। ইংরেজ আমলে রাজানুগ্রহ লাভ করতে হলে ইংরেজি শিখতে হয়, পূর্বে তদ্রূপ মুঘল আমলে ফারসি শিক্ষা ব্যতীত উচ্চ রাজকার্য প্রাপ্তি ঘটিত না। শ্রীকৃষ্ণের পিতা, পিতামহ সকলেই নবাব সরকারেে চাকরি করে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন।শ্রীকৃষ্ণ ও পিতৃপথানুসরণ করে নবাব দরবারে পরিচিত ও প্রতিপন্ন হবার উদ্দেশ্যে পারস্য ভাষা শিক্ষা লাভ করে প্রথম যৌবনে তিনি স্বীয় বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মুর্শিদাবাদে গমন করাই স্থির করলেন।নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে কোন পরাক্রান্ত জমিদার অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেন ও নবাবকে উপেক্ষা করে স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার দমনের জন্য নবাব সৈন্য প্রেরণ করেন; কিন্তু তারা পরাস্ত হয়ে পড়তেন।নবাব বিশেষ ক্রুদ্ধ হয়ে পুনরায় অনেক সৈন্যসহ একজন বিশিষ্ট সেনাপতি প্রেরণ করেন।সৈন্য হতাহত ও সেনাপতি লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসেন।

একজন বিদ্রোহী জমিদার এই রকম বল বৃদ্ধি শুভকর নয় ভেবে তার দমনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের উপর ভার অর্পণ করেন।শ্রীকৃষ্ণ বিশিষ্ট সৈন্যদল নিয়ে ঐ স্থানে উপস্থিত হন এবং সেখানে শিবির স্থাপনপূর্বক পূর্বোক্ত বিদ্রোহী জমিদারের নিকট বন্ধুভাবে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, “সম্রাটের আদেশ মত আমি পূর্ণিয়ায় নবাবকে ধৃত করবার জন্য যাচ্ছি, আপনি শক্তিমান এবং সম্রাটের হিতৈষী, আপনার সাহায্য লইবার জন্য বাদশাহের আদেশ আছে।অতএব আপনি আমাকে সৎপরামর্শ ও সাহায্যদানে বাদসাহের কার্যসাধন ও নিজের স্বার্থ-সাধন করবেন।ভরসা করি এই সুযোগ ত্যাগ করবেন না।”

জমিদার এ প্রস্তাবে অন্ধ হয়ে নবাব হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন। নিজের সামান্য শক্তিকে তিনি প্রবল শক্তি বলে বোধ করলেন, তার ক্ষমতার কথা সম্রাট জানতে পেরেছেন এবং সাহায্য পর্যন্ত চেয়েছেন, এ কি কম কথা! পুর্ণিয়ার নবাবের পদে তাকে স্থাপিত করা বাদশাহের ইচ্ছা হতে পারে।এইরূপ স্বপ্নে কুয়োর মধ্যে তিনি পড়ে গেছেন এবং জমিদার শ্রীকৃষ্ণের জালে পড়লেন। তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শিবিরে হাজির হলেন।শ্রীকৃষ্ণ তাকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগত হলেন। রাজস্বের জন্য জমিদার কারারুদ্ধ হলেন, তার জমিদারি বাজেয়াপ্ত হল।নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ শ্রীকৃষ্ণের এইরূপ কার্য কুশলতা দেখে বড়ই খুশি হলেন এবং দিল্লির সম্রাটের নিকট এই বিদ্রোহ দমনের বিষয় জানালেন।

পরে দিল্লির বাদশাহ শ্রীকৃষ্ণের পদোন্নতি ও যথোপযুক্ত পুরষ্কার প্রদান করতে আদেশ দিলেন।ঐ সময় শ্রীকৃষ্ণ চেীধুরী সরকার বাজুহার অন্তর্গত ময়মনসিংহ পরগনা প্রাপ্ত হলেন।ঐ বৃহৎ পরগণা পূর্বে মোমেনসিং বা মোমিনশাহী নামে অভিহিত হত। জঙ্গলবাড়ির দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা ঈশা খাঁ পূর্বে এই মোমেনশাহী পরগনার অধিকারী ছিলেন।কালক্রমে ঈশা খাঁর অনুসারী রোমান্টিক হিরু খাজা উসমান খাঁ লোহানী, মুঘল দেওয়ানগণ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে এই জমিদারি মঙ্গলসিদ্ধ গ্রাম নিবাসী দত্ত বংশীয়দিগের অধিকারগত হয়।দত্ত বংশীয়েরাই কিছুদিন পরগণার অধিকারী ছিলেন।কালক্রমে রামপুরের নন্দী বংশীয় কোন ব্যক্তি দত্ত বংশে বিবাহ করে বিবাহের যৌতুকস্বরূপ ঐ জমিদারির ছয় আনা অংশ প্রাপ্ত হন।মুর্শিদাবাদে নবাব সরকারে রাজস্ব প্রদানপূর্বক বহুদিন হতেই নির্বিবাদে জমিদারি উপভোগ করে আসছিল। স্বার্থ-চিন্তা ও গৃহ-বিবাদের অগ্নিতে দত্ত-নন্দী বংশীয়দের সুখশান্তি ভস্মীভূত এবং তাদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়।

গৌরীপুরের বোকাইনগরে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বাসস্থান স্থাপন:

এক সময় কেল্লা বোকাইনগর ও কেল্লা তাজপুর বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে দুইটি প্রধান স্থান ছিল। ধনে, জনে, ঐশ্বর্যে, সভ্যতায় এই দুই স্থানই তখন শ্রেষ্ঠ ছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বোকাইন গড় কেল্লার উপকণ্ঠে বাসাবাড়ি (বাশেঁরবাড়ি>বাদশারবাড়ি) এলাকায় তার বাসস্থান নির্বাচন করলেন। পূর্বে যে স্থানে তার সাময়িক রাজবাড়ি, কাছারী, পরগনার প্রধান কাননগো অফিস) নির্মিত হয়েছিল, ঐ স্থানেই তার ঐতিহ্যের উপযুক্ত আবাস গৃহাদি নির্মিত হয়েছিল।এখনও ঐ স্থান বাসাবাড়ি নামে পরিচিত।

পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের একটি শাখা যেমন তার কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষীনারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণের তিন ছেলে শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দ চন্দ্র ও রুদ্র চন্দ্র ঐ বাসাবাড়িতে বাস করে পূর্বপুরুষের বাসস্থান নির্বাচনের গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ'র দরবারের খালসা বিভাগের প্রধান কর্মচারী চাঁদ রায়ের উদ্যোগে জামালপুরে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরির জাফরশাহী পরগণা লাভ:

মোমেনসিং পরগণার জন্য যে রাজস্ব নির্দিষ্ট ছিল তা অত্যন্ত অধিক।ইহা সংগ্রহ করা কোনও জমিদারের সাধ্যের মধ্যে সম্ভব ছিল না। অতএব ঐ পরগণার রাজস্ব কমিয়ে বন্দোবস্ত হোক এভাবে জমিদারের পুত্র চাঁদ রায় জানালেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী পরগণার উন্নতির জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন, পূর্বের জমিদার দত্ত-নন্দীদের প্রতিকূল ও সিন্ধা পরগণার জমিদারের বিদ্বেষে তিনি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তথাপি নিয়মিত রাজস্ব প্রদানে উদাসীনতা বা ব্যতিক্রম করেননি।এজন্য নবাব আলীবর্দী খাঁ শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রতি প্রসন্ন হলেন এবং কি উপায়ে পরগণার রাজস্ব না কমিয়েও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীকে অনুগৃহীত করতে পারেন, তৎসম্বন্ধে কর্মচারীদের পরামর্শ নিতে প্রস্তুত হলেন। শীঘ্রই একটা পরামর্শ মিলল।

তখন জাফরশাহী পরগণার অবস্থা ভাল নয়।রাজস্বও অতি কম।শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীকে ঐ পরগণার দায়িত্ব প্রদান করলে জাফরশাহীর বিশেষ উন্নতি হবে এবং মোমেনসিং পরগণার রাজস্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে।এই পরামর্শই যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করলেন। চাঁদ রায় পূর্ব হতেই সরকারের বিশেষ অনুগৃহীত।ইতিপূর্বে ঘোড়াঘাটে একটি বিদ্রোহ দমন করে নবাব আলিবর্দীর প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। চাঁদ রায়ের চেষ্টা ও উদ্যোগে জাফরশাহী পরগণা মোমেনসিং পরগণার সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। মোমেনসিং পরগণার জন্য যে রাজস্ব নির্ধারিত ছিল, মোমেনসিং পরগণা ও জফরশাহী উভয় পরগণার জন্য ঐ রাজস্বই নির্দিষ্ট হলো।এক পরগণার রাজস্ব দিয়ে তিনি দুইটি সুবৃহৎ পরগণা ভোগ করবার অধিকার প্রাপ্ত হলেন।

নেত্রকোণার মদনপুর ও বেখৈরহাটির নিকট নন্দীপুর গ্রামে কাছারি বাড়ি নির্মাণ: 

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় চৌধুরী নেত্রকোণার মদনপুর ও বেখৈরহাটির নিকট নন্দীপুর গ্রামে কাছারি বাড়িনির্মাণ করেন।ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগরে অবস্থিত বাসাবাড়ি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মোমেনসিং পরগানার প্রধান কাননগো অফিস ও কাছারি বাড়ি ছিল।চাঁদ রায় বৃদ্ধ পিতার অদেশানুসারে বগুড়ায় অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কড়ই নামক বাসস্থান হতে বোকাইনগর বাসাবাড়ি অভিমূখে যাত্রা করেন।পরবর্তীতে মোমেনসিং পরগনার মধ্যস্থলে জমিদারিকার্য পরিচালনা এবং প্রজা বিদ্রোহ দমনের জন্য নন্দীপুরে বাসস্থান নির্মাণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ এর আমলে চাঁদ রায়ের ২৪ বিঘা আয়তনের সুবিশাল দীঘি খনন করা হয়েছিল নন্দীপুরে।দীঘির পাড়সহ ৪০টি বাড়ির জন্য গুচ্ছগ্রামের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন বাংলাদেশ সরকার। এখনও চাঁদ রায়ের ২৪ বিঘা দীঘিটি অতীত গৌরবের নিদর্শনস্বরূপ বর্তমান আছে।

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধর ও উত্তরাধিকার:

বগুড়া জেলার কড়ই জমিদার ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত তৎকালীন মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ের কাননগো পদের অধিকারী এবং গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী কড়ই রাজবাড়িতে দুই বিয়ে করেছিলেন।তার প্রথম পত্নীর নাম ছিল সর্বজয়া দেবী এবং দ্বিতীয় পত্নীর নাম ছিল মহেশ্বরী দেবী।

শ্রৗকৃষ্ণের জীবদ্দশায়ই মোমেসিং পরগনায় জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় এবং কড়ই রাজবাড়িতে চাঁদ রায়ের ছেলে সোনা রায় এবং দ্বিতীয় তরফের মধ্যম ছেলে হরিনারায়ণ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ১৭৫৭/১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।আদমদিঘির কড়ই রাজবাড়িতে তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। তারা পৃথক বাড়িতে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর বিষয় সম্পত্তি অবিভক্ত ছিল। জমিদারির শাসন, সংরক্ষণ, তদারকি একযোগে হতো। জমিদারির দাপ্তরিক কাজও একত্রেই হতো।পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়।

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই অবশিষ্ট চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দুটি তরফ গঠিত হয়েছিল - তরফরায়হিস্যা ও তরফ চৌধুরীহিস্যা।

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী:

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় তার নাতনী সোনা রায়ের মৃত্যুর পর তরফ রায়চৌধুরীর অবশিষ্ট দুই পুত্র নিঃসন্তান থাকায় পলাশী যুদ্ধের পরে কৃষ্ণগোপাল দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজপুত্রকে।তখন দত্তক পুত্রের বয়স ছিল ছয় বছর। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী।কড়ই রাজবাড়িতে এভাবেই নতুন করে যাত্রা শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলারবংশ।

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট চাকলায় ফকির মজনু শাহ এর ভয়ে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দুই তরফ কড়ই রাজবাড়ি ত্যাগ:

সে সময় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট চাকলায় ফকির মজনু শাহ নামে একজন কুখ্যাত দস্যু ছিল।তার ভয়ে সমস্ত চাকলা কম্পিত হতো।অত্যাচারী ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার বা পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর প্রভাবে তরফ রায় ও তরফ চৌধুরী উভয় দলই আত্মকলহের পরিবর্তে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাতে লাগেন। ফকির মজনু শাহ-এর অত্যাচার ও বিদ্রোহী জমিদার মীর সাহেবের শত্রুতাবশতঃ বগুড়ার আদমদিঘির কড়ইগ্রাম ত্যাগ করে জামালপুর জেলা অন্তর্গত জাফরশাহী পরগনায় কৃষ্ণপুর গ্রামে (বর্তমান জেলা শহর) তরফ রায়চৌধুরীর রাজপরিবার এবং মালঞ্চ গ্রামে তরফ চৌধুরীর রাজপরিবার বসবাস করতে শুরু করেন।ঢাকায় অবস্থিত তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুহাম্মদ রেজা খানের নিকট আবেদন করার পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ তরফ রায় হিস্যা ও অপরাংশ তরফ চৌধুরী হিস্যাপ্রাপ্ত হলেন।এর মধ্যদিয়ে বহুদিনের আত্নবিরোধ শেষ হয়।

বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী জাফরশাহী পরগনা ত্যাগ:

জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী জাফরশাহী পরগনা অর্থাৎ জামালপুরের কৃষ্ণপুরে (বাংলা ১১৭১, ইংরেজি ১৭৬৫ সাল হতে বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ইংরেজি ১৭৭০ সাল পর্যন্ত জমিদারি করে আসছিলেন।১৭৭০ সালের মহামারীর ফলে তিনি জাফরশাহী পরগনা ত্যাগ করে মোমেনসিং পরগায় এসে গৌরীপুর কাছারি নামে একটি শহর বা বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন।

রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘গৌরীপুর ঐ সময়ে বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল, কতিপয় নিচ জাতীয় লোকমাত্র গ্রামের অধিবাসী ছিল। যুগলকিশোর রায়ের আগমনে গৌরীপুর জনকোলাহলে মুখরিত হইয়া উঠিল।বন-জঙ্গল পরিষ্কৃত হইল; বহুসংখ্যক বাসগৃহ নির্মিত হইল। যুগলকিশোর রায় নিরাপদ নিশ্চিন্ত হইয়া বিষয়কর্মে নিবিষ্ট হইলেন।’

পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কয়েকটি রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, মানচিত্রগুলোতে বোকাইনগর নামটি কমন রয়েছে তখন বোকাইনগর ছিল প্রাচীন শহর এবং গৌরীপুর ছিল নব্য শহর।গৌরীপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত জমিদারি হলো গৌরীপুর জমিদারি’, যা মযমনসিংহের একটি বড় অংশ ছিল।এর প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ছিলেন নবাব সিরাজের পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী।

২০১২ সালে প্রকাশিত হয় অমলেন্দু দে'র বই ‘সিরাজেরপুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে’।ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. অমলেন্দু দে।তিনি ছিলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সিরাজের বংশধরদের নিয়ে ৫০ বছরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তিনি গবেষণামূলক বইটি প্রকাশ করেন। ২০১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সে বছরই বইটি কমরেড মুজফফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার লাভ করে।

তথ্যসূত্রঃ (১) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার - শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তৃতীয়পুত্র)। (২) ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ - শ্রী কেদারনাথ মজুমদার। (৩) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব - মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা। (৪) ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র। (৫) সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে - ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে। (৬) নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস - আলী আহম্মদ খান আইয়োব। (৭) উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) গৌরীপুর উপজেলা - উইকিপিডিয়া (খ) আদমদিঘি - উইকিপিডিয়া (গ) রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি - উইকিপিডিয়া (ঘ) গৌরীপুর জমিদারবাড়ি - উইকিপিডিয়া (ঙ) জামালপুর ও দয়াময়ী মন্দির - উইকিপিডিয়া। (৮) বাংলাপিডিয়া (৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (11) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (12) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (13) The History of British India- James Mill (14) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (15) David Rumsey Historical Map Collection. (16) New York Historical Society. (১৭) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন - দরজি আবদুল ওয়াহাব (১৮) ময়মনসিংহের রাজপরিবার - আবদুর রশীদ।

লেখক: 
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী

রায়হান/এবি/

মন্তব্য করুন: