আলু থেকে পচনশীল পলিথিন উদ্ভাবনের রেকর্ড করলো গৌরীপুরের তিন তরুণ

ছবি- সংগৃহীত
আলুর স্টার্চ, পানি, হোয়াইট ভিনেগার, গ্লিসারিনের সংমিশ্রণে মুর্হূতেই তৈরি হচ্ছে পচনশীল পলিথিন। যা ব্যবহারের পর পানিতে ফেলে দিলে পচেঁ ৫দিনের মধ্যে মাছের খাবারে পরিণত হবে। সেই পলিথিন মাটিতে ফেলে দিলে ১৫দিনে জৈবসারে রূপ নিবে। যা বর্তমান পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হবে। আলুর স্টার্চ থেকে এ পলিথিনের উদ্ভাবন করেন তিন তরুন। তারা হলেন মাহাদী নূর আহমেদ, রিফাত মিয়া ও ওমর ফারুক।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ময়মনসিংহের গৌরীপুর টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে স্কিলস অ্যান্ড ইনোভেশন কম্পিটিশন মেলার উদ্ভাবনী প্রদর্শন করা হয়। মেলার সমাপনীতে মেলা পরিদর্শন ও বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধান অতিথি ময়মনসিংহ কারিগরি বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক সুলতানা রাজিয়া।
এ সময় তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আলু স্টার্চ থেকে পচনশীল পলিথিন উৎপাদন করেছে। যা পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, আমরা এটার স্থায়ীত্ব, উৎপাদন খরচ এবং পুরো একটি পলিথিন কতটুকু ওজন বহন করতে পারবে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এ উদ্ভাবনকে আরও ফলপ্রসূ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের এ আয়োজন, সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
আলু থেকে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ উৎপাদন দর্শকদেরকেও মুগ্ধ করেছে।
এ প্রসঙ্গে ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন জানায়, আলু থেকে পটেটো চিপস হয়, আলুর চপ ইত্যাদি শুনেছি। এই প্রথম দেখলাম আলু থেকে কিভাবে পলিথিন উৎপাদন করে। একই বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী নৌরিন সুলতানা জানায়, পলিথিন শুনেই খারাপ লাগছিলো। কিন্তু আলু থেকে পলিথিন উৎপাদন, দেখে আমি বিষ্মিত হয়েছি!
উদ্ভাবনি প্রদর্শনী স্টলের লিডার মাহাদী নুর আহমেদ জানান, বর্তমানে বাজারে যে পলিথিন রয়েছে তা ৪-৫শ বছরেও ধ্বংস হয় না। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সেই স্থানে আমরা আলু থেকে পলিথিন উদ্ভাবন করেছি। এ পলিথিন পানিতে ফেলে দিলে ৫দিনের মধ্যে দ্রবণ হয়ে মাছের খাদ্যে পরিণত হবে। আর মাটিতে ফেলে দিলে ১৫দিনের মধ্যে পচে জৈব সারে পরিণত হবে।
তিনি আরও জানান, প্রত্যেকটি পলিব্যাগে ৭-৮ কেজি মালামাল পরিবহন করা যাবে। ভিনেগার, গ্লিসারিন, পানির সাথে আলুর স্টার্চ মিশ্রণে পলিথিন তৈরি করা হয়। এক কেজি আলু দিয়ে ২ফুট বাই এক ফুটের ১০টি পলিব্যাগ হবে। ছোট আকৃতির ৩০টা পলিব্যাগ হবে। উৎপাদন খরচ একটু বেশি। এ কাজে সহযোগিতা করেন কলেজের ইন্সট্রাক্টর রাকিবুল ইসলাম।
তিনি আরও জানান, দেশিয় বর্তমান পলিথিন পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। আর এ পলিথিন মার্টির উর্বরতা বাড়াবে, পানিতেও মাছের খাদ্য তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এ প্রসঙ্গে ৮ম শ্রেণির ছাত্র রিফাত মিয়া জানায়, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্লাস্টিককে পর্যবেক্ষণে দেখা যায় হাইড্রোকার্বনের খুব ছোট ছোট কণা বা মনোমার পরপর সজ্জিত হয়ে দীর্ঘ শিকলের পলিমার সৃষ্টি করে। এ রকম অনেক পলিমার একত্র হয়ে প্লাস্টিক তৈরি করে। প্লাস্টিকের পাতলা ব্যাগ পলিমারের তৈরি বলে তাকে বলা হয় পলিথিন। এই হাইড্রোকার্বন পলিমার মাটিতে পচে না, বরং অনেক দূষণ সৃষ্টি করে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি এই পলিথিন।
দলগত উদ্ভাবনের আরেক ক্ষুদে বিজ্ঞানী ওমর ফারুক জানায়, পলকা হচ্ছে সেই পরিবেশবান্ধব পচনশীল পলিমার। যা আমরা আলু দিয়ে তৈরি করেছি। আলুর স্টার্চ, পানি, হোয়াইট ভিনেগার, গ্লিসারিন। গোল আলু ধুয়ে পরিষ্কার করে ছিলে নিতে হয়। তারপর খোসা ছাড়ানো সেই আলুকে কুচি কুচি করে কেটে বা গ্রিটারে গ্রেড করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১০ মিনিট। তারপর হাত দিয়ে চেপে বা অন্য যেকোনো উপায়ে চেপে চেপে ভেতরের সব নির্যাস বের করে নিতে হবে। শেষে সেই পানিটা কোনো পরিষ্কার পাত্রে রেখে দিলে তলায় স্টার্চ জমা হবে। এই স্টার্চটা লালচে ময়লাযুক্ত থাকবে। একে কয়েকবার পাতন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিলে ধবধবে সাদা পরিষ্কার স্টার্চ পাওয়া যাবে। প্রতি ১০ কেজি আলু থেকে ১৩০০ থেকে ১৬০০ গ্রাম স্টার্চ তৈরি করা সম্ভব।
ইনোভেশন মেলার সমাপনি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রকৌশরী সিদ্দিক আহমেদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কলতাপাড়া ডেল্টা স্পিনার্স মিলস্রে ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম মো. মিজানুর রহমান।
মেলায় প্রথম স্থান অর্জন করেন আলু হতে পচনশীল পলিথিন, দ্বিতীয় স্বয়ংক্রিয় পানি নিষ্কাশন ও তৃতীয় ট্রাফিক লাইট ছাড়া সড়ক বিভাজক। প্রথমস্থান অর্জনকারী মাহাদী নূর আহমেদ চান্দের সাটিয়া গ্রামের সাজ্জাদুল আলম ও হোসনে আরা খেয়ার সন্তান, রিফাত মিয়া রামগোপালপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের মৃত আকবর আলীর পুত্র, ওমার ফারুক রাফি পৌর শহরের বালুয়াপাড়ার শফিকুল ইসলাম ও এলিনা আক্তারের পুত্র। স্বয়ংক্রিয় পানি নিষ্কাশন উদ্ভাবন করে ক্ষুদে বিজ্ঞানী জাসিয়া জান্নাত পৃথিলা ও জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি, ট্রাফিক লাইট ছাড়া সড়ক বিভাজক উদ্ভাবন করে ক্ষুদে বিজ্ঞানী মো. সিয়াম, রামিমুল হক মিতুল ও মো. জুয়েল।
সকালে ভার্চ্যুয়ালি এ মেলার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রকৌশলী আবুল খায়ের মো. আক্কাস আলী। সভাপতিত্ব করেন বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. রকিব উল্লাহ।
মন্তব্য করুন: