• ঢাকা

  •  বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

ফিচার

গৌরীপুরে শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া নদী এখন রূপকথার গল্প

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার

 আপডেট: ১১:৫৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

গৌরীপুরে শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া নদী এখন রূপকথার গল্প

ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বদিকে গৌরীপুর উপজেলা সদরের অবস্থান। সুদূর অতীতে গৌরীপুরের বোকাইনগর মোমেনসিং পরগনার রাজধানী ছিল। ময়মনসিংহ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত। এক সময়ে এই ময়মনসিংহে নদী পথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বনিকেরা ব্যবসার জন্য আসতেন। কালের বির্বতনে বিলীন হয়েছে এবং হতে চলেছে এই ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা প্রশাখার অস্তিত্ব। 

ব্রিটিশ ভূবিদ, ভূগোলবিদ, নৌ-প্রকৌশলী, ঐতিহাসিক এবং মহাসমুদ্রবিদ্যার জনক জেমস রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, আড়াইশ’ বছর আগে মোমেনসিং এবং আলাপসিং পরগনার সীমানা ঘেঁষে সাগরের মতো ব্রহ্মপুত্র নদের অথৈ পানি খেলতো এপার থেকে ওপার পনের থেকে বিশ কিলোমিটার জুড়ে। সে সময় ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করতে ৫ থেকে ৬ ঘন্টায় সময় লাগতো।

তখন দেশের প্রধান নদ-নদী ছিল তিনটি- ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং মেঘনা। তখন যমুনা ও পদ্মা সৃষ্টি হয়নি। ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য উপ-নদীর পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী সৃষ্টি হয়। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা যমুনা নদী নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে দৌলতদিয়ার কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। বর্তমান (২০২২)  ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্থতা এবং কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, ত্রিশ ভাগের এক ভাগ অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র নদের সর্বাধিক প্রস্থ ১০ হাজার ৪২৬ মিটার (বাহাদুরাবাদ)।

নদীমাতৃক, ভাটি অঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের অতি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। শত শত বছরের প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে এখানে। এ রকম প্রাচীন ও সুস্পষ্ট ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কাজ করছে। সংগঠনের মাধ্যমে অজানাকে জানার জন্য ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায়, তথ্যসূত্র, জনশ্রুতি, প্রাচীন মানুষের কথা,  ঝরে পড়া অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ, প্রাচীন দুর্লভ তথ্য ও প্রাচীন মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে আপডেট ইতিহাস রচনা করা হয় বা হয়ে থাকে। প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এসিক এসোসিয়েশন ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রতিবছর একটি স্বনামধন্য আঞ্চলিক তথ্যবহুল ম্যাগাজিন ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’ প্রকাশিত হয়।

উল্লেখ্য, রেনেলের মানচিত্র অথবা ইতিহাসের পাতা থেকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তন এবং উত্তরে ঘন ঘন পাহাড়ি ঢলে মেঘালয়ের পাহাড়ি পলি বয়ে নিয়ে আসা, ভাটিতে নদীগুলোর স্রোতের গতি কমে গিয়ে নদীর তলদেশে পলি সঞ্চিত হয়ে শত বছর ধরে ভরাট হয়ে ক্রমে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে বিলীন হয়েছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ৭ থেকে ৮টি শাখা নদ-নদী। এসব নদী এখন মরা খাল এবং বিলে পরিণত হয়েছে। বহুদিন আগে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বড় বড় চর ভেসে মহল্লা, পাড়া, গ্রাম ও গঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে । এসব নদীতে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। মানুষজন পায়ে হেঁটে বিভিন্ন পাড়ায় যেতে পারে যা এক সময়ে নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। প্রবাহমান এসব নদ-নদী শাখা-প্রশাখা নদী, ছড়া নদী, নালাগুলো এখন এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। এই ফিচারে গৌরীপুর থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বড় নদীর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্রে গৌরীপুরের মধ্য দিয়ে নদীপথঃ

জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্র অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন মানচিত্র। এক সময়ে তা দুষ্প্রাপ্য ছিল। ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’ নামে একটি তথ্যবহুল ম্যাগাজিনে প্রাচীন মানচিত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীন মানচিত্রে  তৎকালীন গৌরীপুর এলাকার দিকে দৃষ্টি দিলে গৌরীপুর নামে কোনো জনপদ বা স্থানের নাম পাওয়া যায় না; বরং বোকাইনগর, শিমূলকান্দি, রামপুর, সরিষাহাটি, পেচাংগিয়া, সোনাজুরি, তেলিগাতি, মধুপুর, রাঘুবপুর, কাশিগঞ্জ, পরানগঞ্জ, জঙ্গলবাড়ি, বাইগনবাড়ি ইত্যাদি প্রসিদ্ধ স্থান দেখানো হয়েছে। বর্তমান বোকাইনগর গৌরীপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন, সরিষাহাটি এবং পেচাংগিয়া এই উপজেলার অন্তর্গত দু’টি গ্রাম।

রেনেলের মানচিত্রকে মিলিয়ে দেখলে গৌরীপুর পৌরসভার পূর্বপাশ দিয়ে সেসময়ের একটি জাতীয় নদীর গতিপথের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির সুন্দর একটি চিত্র ফুটে ওঠে। এতে পরিষ্কার ধরা পড়ে বর্তমান সময়ে ভালকি বিল, ডালিয়া বিল, জলভূরুঙ্গা ইত্যাদি জেমস রেনেলের সময়কালের খরস্রোতা নদীর গতিপথের চিহ্ন হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। 

সেদিনকার শ্যামগঞ্জ ও কাউরাট হতে একটি নদীর গতিপথ কিশোরগঞ্জ জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত ছিল। এতে দেখা যাচ্ছে, দুইশ’ বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ সংকুচিত হওয়ার সময়ে তার শাখা নদীসমূহ বিলীন হতে শুরু করে। রেললাইন স্থাপনের সময়ে নদীটি  আরো বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে গৌরীপুরে শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বড় নদী যেন এখন রূপকথার গল্প।

রেনেল অংকিত মানচিত্রে প্রাচীন নদীর বর্ননাঃ

রেনেল অংকিত প্রাচীন মানচিত্রে গৌরীপুরের ওপর দিয়ে মূল নদীটির নামকরণ জানা যায়নি। গবেষণা ও সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর চলা পথে বিভিন্ন শাখা প্রশাখা নদীতে পতিত হয়েছিল। বিভিন্ন নদ নদী পতিত হওয়ার কারণে মূল নদীর অনেক মিলনস্থল ছিল। প্রতি  মিলনস্থল থেকে নদীর নতুন নতুন নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন - কাইড়া নদী, ভালকি নদী, সুরাইয়া নদী, জলভুরাঙ্গা নদী ইত্যাদি। বালুয়া নদী ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গৌরীপুর উপজেলার একটি আঞ্চলিক নদী। বালুয়া নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে গৌরীপুর ভিলেজ টাউন বা শহর। 

বালুয়া নদী এক সময়ে গৌরীপুর শহর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদী ছিল। নদীটি উত্তরে প্রবাহিত হয়ে ভালকি নদীতে পতিত হয়েছে। সোয়াই নদী বা সোয়াইন নদী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর বাম তীরের শাখানদী। এটি বেশ পুরোনো একটি নদী। একসময় ধান ও পাটবোঝাই করা নৌকা তার বুকে বয়ে চলতো অহরহ। প্রাচীনকালে শাহগঞ্জে একটি নদীবহুল এলাকা ছিল। সেখানকার সবগুলো নদীই খরস্রোতা ছিল। আড়াইশ’ বছর আগের রেনেলের মানচিত্র দেখে মনে হচ্ছে নামহীন একটি বড় নদী জঙ্গলবাড়ি হতে শাহগঞ্জ বাজার, তাজপুর ও ভূটিয়ারকোনার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে শ্যামগঞ্জ বাজার নিকটে সোহাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ নদীর অনেক শাখা নদী থাকা কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছিল। তাই মানচিত্রে নদীর নামটি দেওয়া হয়নি।

দক্ষিণ হতে ভূরুঙ্গা নদী, বোকাইনগর হতে চামারখালী নদী, গৌরীপুর হতে ভালকি নদী, পাটেশ্বরী নদী হতে সুরিয়া নদী যা শাহগঞ্জ বাজারে মিলিত হয়েছিল। এ বিশাল জলরাশির জন্য ঐ জায়গার নাম রাখা হয়েছিল পাচঁকাহনিয়া। পাঠান ও মুঘল আমলে এই স্থানে নদীর বিস্তার অধিক থাকার কারণে নদী পারাপার জন্য পাঁচ কাহন কড়ি নির্ধারিত ছিল। ফলে জায়গাটি পাচঁকাহনিয়া নামে পরিচিত হয়। বর্তমান পাচঁকাহনিয়া একটি গ্রাম হিসেবে পরিচিত। 

কোচ বা ভূটিয়ার যুগে ভূরুঙ্গা মাছের প্রাচুর্য থেকে নদীর নামকরণ করা হয়েছিল ভূরুঙ্গা। বর্তমান সেখানে জল ভূরুঙ্গা বিল হিসেবে পরিচিত। ‘গাভীশিমূল দালানবাড়ি’ ময়মনসিংহের গৌরীপুর শহর থেকে এর দূরত্ব দুই কিলোমিটার। এটি গৌরীপুর উপজেলা হাসপাতাল কমপ্লেক্স থেকে আধা কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। বারোভুঁইয়ার সময় থেকে ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য বহনকারী সর্দারবাড়ি যা মোমেনসিং পরগনার পাঠান সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ গ্রামের ৯৩ বছর বয়সি আইনল হক বলেন, এ বাড়ির নির্মাণের সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না। তিনি অতীতের স্মৃতি ঘেটে বলেন, তার বাবা আব্দুর রহমান মুন্সী ৯২ বছর এবং দাদা অলি মাহমুদ সরকার ১২০ বছর বয়সে মারা যান। তার দাদার দাদারও জানে না ভবনের ইতিহাস। তিনি আরো বলেন, দালানের পূর্বদিকে একটি বিশাল নদী ছিল যা কাইড়া নদীর নামে পরিচিত। কাইড়া নদী ছিল তাদের বাড়িসংলগ্ন। বর্তমানে সেখানে ধান ক্ষেত ও বসতবাড়ি। 

কথা বলতে বলতে তিনি খানিকটা থেমে তার স্মৃতি মন্থন করতে থাকেন। তারপর বলেন, তার হৃদয়ে গেঁথে আছে কাইড়া নদীর নামকরণের ইতিহাস। নদীর ওপারে ছিল গভীর জঙ্গল। সেখানে বাঘসহ নানান প্রজাতির বন্যপ্রাণির বসবাস ছিল। তাই নদীর ওপারে একা কেউ বা কোন গরু ছাগল গেলে বন্যপ্রাণিরা ওত পেতে কাইড়া নিতো, কিংবা হয়তো বাড়িতে ফিরে আসতো না। তাই নদীর নাম কাইড়া। তিনি আরো বলেন, দুই নদীর সংযোগস্থল এখানে, নদীতে খরস্রোত ও অনেক কুড় ছিল। নদীর পথে যাওয়ার সময়ে অনেক বণিক মানত করতো। এই ইতিহাসটি শত শত বছরের পুরানো মুখের কথা যা বইয়ে লেখা হয়নি। কাইড়া নেয়ার এই করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় কাইড়া। 

কাইড়া সাথে ভালকি নদীর সংযোগ এবং বায়রাউড়া গ্রামে ভালকি নদীর সাথে লন্ডনি নদীর সংযোগস্থল। এই নদীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নদীপথ ব্যবহার করে ইউরোপিয় বণিক, সওদাগর এমনকি রাজা জমিদাররা ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন স্থান। তখন এই নদীর প্রশস্ততা ছিল এক থেকে দুই-তিন কিলোমিটারের মতো। নদীর গভীরতা ছিল একশ’ ফুটের অধিক। তাই এক সময় বড় বড় নৌকা এমনকি ছোট ছোট জাহাজ তার বুকে বয়ে চলতো অহরহ। রেনেল অংকিত আরেকটি মানচিত্রে Map of the Island Navigation (1778) গৌরীপুর উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত কিশোরগঞ্জ হতে সুসং পর্যন্ত একটি নদীপথের সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে।

নব্যতার সংকটে বর্তমানে প্রাচীন নদীটি বিভিন্ন স্থানে খাল-বিল ও ফসলের মাঠঃ

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নদীর গতিপথ নষ্ট হয়ে যায়। নাব্যতা হারিছে বহুদিন আগে ও চর পড়ে বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন প্রবীণরা। নব্যতার সংকটে বর্তমানে প্রাচীন নদীটি বিভিন্ন স্থানে খাল-বিল ও ক্ষেতে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও গোচারণ-ভূমি ও পুকুর। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বসতবাড়িও। এ সবই ঘটেছে মাত্র এক-দুই শতকে। প্রবীণরা বলেছেন, একসময়ে সিলেট ও কলকাতা থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত ভালকি নদীতে সরাসরি স্টিমার ও বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। নদীটি গভীর ও প্রশস্ত থাকায় এক সময়ে ছোট জাহাজ পর্যন্ত চলাচল করতো। বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের ১০ ভাগ জলই ধারণ করতো এই নদী। ভালকির অনেক জায়গায়  ১০০-১৫০ ফুট পানি থাকতো। জলভূরুঙ্গা আরো গভীর ছিল। 

তবে গ্রামবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, ভালকি ও জলভূরুঙ্গার চোরাবালিতে দেও-দৈত্যের বসতবাড়ি রয়েছে। কেউ মনে করেন শত শত বছর আগে জাহাজ ডুবে বিলের তলায় জ্বীন-পরী ও ভূতের আখড়া সৃষ্টি হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিলের ধারে বা পানিতে কেউ একা যায় না। আবার কেউ কেউ দৈবশক্তির উছিলায় কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মানত করে থাকেন। এই বিলগুলো নিয়ে অনেক ভয়নক মৃত্যু, নৌকাডুবি, পুকুর খনন, নরম মাটিতে মরণ ফাদঁ, মাছ ধরা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা বা কাহিনী রয়েছে। নব্যতার সংকটে জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাধীনতার পর থেকেই  অর্থাৎ গত ৫০ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে সে সকল নৌরুটের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা।

হারানোর নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছেঃ

নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো অতীতে কেমন ছিল তা জানতে আমাদের বেশ এক-দুই শতক পিছনে ফিরে যেতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় স্থান হলো কোনাপাড়া, হাটশিরা ও ইছুলিয়ার প্রাচীন মসজিদ যা শত শত বছরের ইতিহাসের যাত্রাপথের সাক্ষ্য বহন করে। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে হিজলবন। একসময় ভালকি নদীর এই অংশ প্রচণ্ড স্রোত বইতো। স্রোত আর ঢেউয়ের তাণ্ডবে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো চরম ভাঙনের মুখে পড়েছিল।

ভালকি বিলের তীরে ঐতিহাসিক ও রোমান্টিক স্থান কোনাপাড়াঃ

ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার ভালকি বিলের তীরে অবস্থিত কোনাপাড়া হতে পারে এক বিকেল কাটানোর দুর্দান্ত স্থান। কোনাপাড়ার ইতিহাস হলো দুই-তিনশ’ বছর আগে ভালকি নদীর বুকে ভেসে ওঠা একটি চরের নাম। ষাট দশকে গৌরীপুর শহরের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের অবস্থান ছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন সেখানে একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভালকি বিলের তলার কাদার পরিমান বেশি হওয়ার কারণে ভিন্ন কৌশলে পিলার না দিয়ে শুধু উপর-নিচে ঢালাই দিয়ে একটি বক্সকালভার্ট আকৃতির সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে এই সেতুর উপর দিয়ে ভারি ট্রাক চলাচল করলে যে কোন সময়ে এটি ভেঙ্গে যেতে পারে। পরবর্তীতে আরো দুটি সেতু নির্মাণ করে হাটশিরা ও বায়রাউড়া গ্রামের সাথে কোনাপাড়া সংযুক্ত হয়। 

পাকিস্তান ও বৃটিশ আমলের শেষের দিকেও পুরাতন ভালকি নদী গৌরীপুর শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ ছিল। তখন ভালকি তীরে গড়ে উঠেছিল রেলওয়ে জংশন, পুরাতন চালকল, পাট অমদানি রপ্তানি প্রক্রিয়া কেন্দ্রসহ অনেক সরকারি পাটগুদাম, প্রসিদ্ধ চামড়ার বাজার, ধান শুকানোর চাটাইয়ের (ধারি) বাজার ইত্যাদি। কোনাপাড়ার দুইপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভালকি বিল পূর্নিমা রাতে আপনাকে মুগ্ধ করবেই। বর্ষাকালে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যও উপভোগ করা যায় এই গ্রামে।

ভালকি বিল তীরবর্তী হাটশিরা, ইছুলিয়া, দৌলতপুরঃ

প্রকৃতি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন যারা তাদের জন্য ছুটির দিনে বেড়ানোর আদর্শ জায়গা হতে পারে হাটশিরা ও ইছুলিয়া গ্রাম। বর্ষাকালে রিভারভিউ দেখার এটি একটি সুন্দর স্থান। যা হাটশিরা, ইছুলিয়া ও কোনাপাড়া গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি বিলের অংশবিশেষ। বিলের পাশ দিয়ে সারি ধরে অনেক পুকুর আছে। সারি সারি পুকুর, ধানক্ষেত, খাল-বিল আর গাছপালার কারণে সেখানকার পরিবেশ অনেকটাই গ্রামীণ। বিল ঘেঁষে রাস্তার ধারে কিছু চায়ের দোকানও পাবেন। ভালকি তীরের মুক্ত বাতাস ও কোলাহলহীন পরিবেশে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে অবসর সময় কাটানোর জন্য অথবা এলাকাবাসীর সঙ্গে আড্ডা দেয়ার জন্য একটি সুন্দর জায়গা। 

এলাকার মানুষ জানায়, বিলের ধারে সারি সারি পুকুর খনন করার সময়ে মাটির নীচে অনেক হিজল গাছের গুঁড়ি ও কাঠ পাওয়া যেতো। এখনো মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। সম্ভাব্য নদীভাঙ্গন মোকাবেলায় দৌলতপুর হতে হাটশিরা-ইছুলিয়া পর্যন্ত জারুল গাছের সারি ও হিজলবন ছিল। অতীতের কথা ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হিজলবন, বড় বড় নৌকা ও সেই সময়ের লোকজনের চেহারা। ইছুলিয়া বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে চার-পাঁচশ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এই মসজিদটি কে নির্মাণ করেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় তৎকালীন বাংলার মুসলিম-স্থাপত্যের মোমেনসিং পরগনার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইছুলিয়া প্রাচীন জামে মসজিদটি দেখলে মুঘল ও পাঠান আমলের চিত্র ফুটে ওঠে মনের আয়নায়।

প্রাচীন নদীর চরের অন্যতম নিদর্শন পাছারকান্দা ও বায়রাউড়াঃ

প্রাচীন নদীর চর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত অন্যতম নিদর্শন পাছারকান্দা ও বায়রাউড়া গ্রাম। গৌরীপুর উপজেলা শহরের মধ্যবাজার থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বদিকে পাছারকান্দা অবস্থিত এবং এর আধা কিলোমিটার পূর্বদিকে বায়রাউড়া গ্রামের অবস্থান। বালুয়া বিলের একটি খালের জন্য গ্রামগুলো দুইটি অংশে বিভক্ত। পাছারকান্দার উত্তরে ভালকি বিল এবং দক্ষিণে বালুয়া বিলের অবস্থান। পাছারকান্দার ইতিহাস হলো দুই-তিনশ’ বছর আগে ভালকি নদী ও বালুয়া নদীর মাঝে ভেসে ওঠা একটি চরের নাম। প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া আর উজার করা সৌন্দর্যে মনোরম পরিবেশে আকৃষ্ট হয়ে শহর থেকে অনেক লোক প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসেন। মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পাখির কিচির মিচির শব্দ মুখর করে রাখে প্রতিটি মুহূর্ত। বায়রাউড়া গ্রামের উত্তর-পূর্বে ভালকি বিল, লন্ডনি খালের দক্ষিণপাড়ে অচিন্তপুর গ্রাম এবং পশ্চিমে বালুয়া বিল অবস্থিত। বায়রাউড়া গ্রামের ইতিহাস হলো দুই-তিনশ’ বছর আগে ভালকি নদী ও লন্ডনি নদীর মাঝে ভেসে ওঠা একটি চরের নাম।

প্রবীণ ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও ভালকি বিলে বিভিন্ন দুর্ঘটনার মুখে বিভিন্ন লোকের মিশ্র প্রতিক্রিয়া -

স্রোতহীন হয়ে পড়ে থাকা ভালকি নদী এক সময়ে হ্রদে পরিণত হয়। ক্রমে ক্রমে পলি ভরাট হয়ে ষাট দশকে বিলে পরিণত হয়। পানির সংগে প্রবাহিত মাটির কনা, এঁটেল-দোআঁশ পলি, বালুকনা, নূড়ি, কয়লা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনার পরিমাণ বেশি এবং তা নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমাণ অধিক হওয়ায় বর্তমানে একটি দীর্ঘ নদীর ৮০ শতাংশই ভরাট হয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানায়, ভালকি বিল এক সময়ে একটি নদীর অংশ ছিল। তা কেউ জানে না, তবে এখানে অনেক চোরাবালি রয়েছে। বিলের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু করলে বা পানিতে নামলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ ধরণের আলোচনা আছে সাধারণ মানষের মুখে মুখে। তা ছাড়াও, বিলের তলার কাদার পরিমান বেশি হওয়ার কারণে মানুষ সোঁজা হয়ে দাঁড়ালে সহজেই ঢেবে যায় কোমর বা বুক পর্যন্ত। তাই বিলের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকার কারণে চোরাবালির কাদার পুরুত্ব ২০-২৫ ফুট হতে পারে। এখানে বিগত দশ বছরে দুর্ঘটনায় অন্তত তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে দেশের সংবাদমাধ্যমে। 

১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এই বিলে পণ্যবোঝাই বড় বড় নৌকা চলাচল করতে অনেকেই দেখেছেন। এক-দুইশ’ বছর আগে বিল যখন নদী ছিল তখন নদীর তলা হতে পানির উপরিভাগ পর্যন্ত ১০০-১৫০ ফুট গভীর থাকতো সবসময়।তখন এমনও হতে পারে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল বড় বড় নৌকা, আইল্যান্ড নেভিগেশন জাহাজ যা বালির তলায় ডুবে আছে শত শত বছর ধরে। 

অতীতে ভালকি বিলের তলায় বালির পরিমান কম থাকায় বিশাল গর্ত সহজে ভরাট হতে পারেনি। ফলে সেখানে অতিরিক্ত কাদা জমে চোরাবালি বা মরণফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে। 

তবে, ভালকি বিল যে একটি গভীর নদীর চিহ্ন, এই ইতিহাস সকলের জানা প্রয়োজন।

দৌলতপুর গ্রামের হাজি মোঃ ফজলুর রহমানের কথায়, ঢুলিপাড়া মৌজায় ভালকি বিলের কিনারা ঘেঁষে নিচু জমিতে ১৯৮৮ সালে কিছু অংশ খনন করে পুকুর করার সময় কাদার উপর ১০-১২ ফুট উচু পাড় তৈরি করা হয়েছিল। কিছুদিন পর হঠাৎ ওজনের ভারে পাড়ের অনেক অংশ একেবারে ঢেবে গিয়েছিল। এই ঘটনা বেশ অবাক করেছিল এলাকাবাসীকে। তিনি আরো বলেন, পুকুর খনন করার সময় বড় হিজল গাছের গুঁড়ি, গাছের ডালপালা, একটি মানুষের কংকাল, পাঁচ থেকে সাতমণ কয়লার মতো বস্তু পাওয়া গিয়েছিল। বিলের চরের অতিরিক্ত কাদায় মানুষ, গবাদিপশুও আটকে যেতো। সেখানে একা একা চলা অনেক ভয়ের ছিল। 

হাজী মোঃ ফজলুর রহমানের কথায় এটিই প্রমাণ করে, ভালকি নমে একটি প্রবাহমান নদী ছিল। ঢেউয়ের আঘাতেও অনেক সময় পাহাড় পর্বত থেকে পলি মাটির সাথে সাথে কয়লা জাতীয় পদার্থ আসতো। 

কোনাপাড়া গ্রামে জন্ম ৭৩ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আবুল কালামের। তার কথায়, পাকিস্তান আমলেও নৌকার লগি ভালকি বিলের মাঝখানের তলা স্পর্শ করতো না। কিনারায় লগি দিলে কাদার মধ্যে ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত ঢেবে যেত। তিনি ভালকি বিলের ইতিহাস শুনেছেন বাবা-দাদার মুখে। ‘ব্রিটিশ আমলে ডিঙি নৌকা বিল পাড় হওয়ার সময়ে তখন বড় বড় মাছ লাফিয়ে উঠতো। এমনকি মাঝি-মাল্লা, নৌকার মধ্যে লোকজন মাছের আঘাতে আহত হইতো’, বলেন তিনি।

কোনাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রাখাল চন্দ্র দাস জানান, ৩০-৩৫ বছর আগে কোনাপাড়ার ভালকি বিলে একটি মানুষের কংকাল দেখেছিলেন। ৪০ বছর আগেও বিলের একটি কুড়ের কাছে দুই-তিনটি মানুষের মাথা ও হাড়গোড় দেখেছিলেন। 

একই গ্রামের কৃষক আলী হুসেন বলেন, পূর্বপুরুষের মুখে তিনি শুনেছেন যে, বাংলা ১৩৫০ সালে বালুয়া বিল থেকে আসা ২০-২৫ জন লোক শখের বশে ভালকি বিলে পোলো দিয়ে মাছ শিকার করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষ চোরাবালিতে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তখন ছিল চৈত্র মাস। সেসময় গ্রামের লোকেরা মনে করতেন বিলের মধ্যে বসবাসকারী দেও-দানবরা এ কাজটি করেছে এবং প্রতি বৈশাখ মাসে তাদের ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হতো। 

গৌরীপুর হারুণ পার্কের সামনে চায়ের দোকান চালান ৫৬ বছর বয়সি মোঃ জামাল উদ্দিন। তিনি একটি ঘটনা বলেন প্রায় ৪০ বছর আগের। তিনি ভালকি বিলের কিনারা ঘেঁষে একটি মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। ঘাস কাটার সময় হঠাৎ তার সমস্ত শরীর কাদার নিচে দিকে টানতে থাকে। তার চিৎকার শুনে তার বন্ধু চাঁন মিয়া গরুর দড়ি দিয়ে বেধে টেনে তাকে উদ্ধার করেন। 

প্রায় একই রকম ঘটনা ঘঠে সরকারপাড়ার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক মো নজরুল ইসলামের শৈশবে। ৪২-৪৩ বছর আগে ভালকি বিলের পশ্চিমে মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে যান তিনি। সর্তকতার সঙ্গে চলাচল করার পরও হঠাৎ তিনি নরম মাটির কাদায় কোমড়-বুক পর্যন্ত ঢেবে গিয়েছিলেন। তখন মাঠে কর্মরত লোকেরা তাকে উদ্ধার করেন।

বায়রাউড়া গ্রামের শেষ বাড়িটি মো. আজিজুল হক রিপনের। এই বাড়ির মাটিতেই বেড়ে ওঠেছেন তিনি। এ গ্রামের বিশেষত্ব হচ্ছে, উত্তরে ভালকি বিল দিয়ে কোনাপাড়া গ্রাম পৃথক আর দক্ষিণে লন্ডনি নদী বা খাল দ্বারা অচিন্তপুর গ্রাম পৃথক এবং পশ্চিমে বালুয়া বিলের খাল দ্বারা পাছারকান্দা পৃথক করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেড়শ’ বছর আগে  খরস্রোতা লন্ডনি নদীতে চুনবোঝাই একটি বড় নৌকা তীর গতিতে এসে পাড়ের কাছে ডুবে গিয়েছিল। ষাট দশকে নদীর স্বচ্ছ পানিতে ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে চুনের পাথর দেখা যেতো। তখন এক বৃদ্ধ বলেন, প্রায় শতবছর আগে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন এই দুর্ঘটনাটি। বর্তমান (২০২২) রিপন ওই স্থানে গিয়ে জানান, প্রায় ৪০ বছর আগে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন পানির নীচে চুনাপাথর। চুনাপাথরের উপর ১০ ফুট পর্যন্ত পলিমাটি জমে আছে। এখানে খনন করলে চুনা পাথরগুলো পাওয়া যাবে।

বায়রাউড়া গ্রামের মোঃ নজরুল ইসলাম নলকূপের কাজ করেন। তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ তার নিজ গ্রামে, তিনি বলেন  দুই-তিন মাস আগে গ্রামের একটি এলাকায় একটি নলকূপ স্থাপনের সময় মাটির ভূগর্ভের ১৮০ ফুট নিচ থেকে একটি কাঁচা কাঁঠাল গাছের টুকরা পাওয়া গিয়েছিল। তখন মাটির নিচে গাছের উপর লম্বা পাইপ কসরত বা পাইলিং করতে গিয়ে দুই-তিন ঘন্টা সময় লেগেছিল। তা ছাড়াও অচিন্তপুর গ্রামে আরও একটি নলকূপ স্থাপনের সময় মাটির ভূগর্ভের ৮০ ফুট নিচ থেকে একটি নৌকার কাঠের  টুকরো পাওয়া গিয়েছিল।

গত এক দশকে ভালকি বিলের পানিতে ডুবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে

পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক ঘটনা নথিভুক্ত হয় না।  সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত এক দশকে ভালকি বিলের পানিতে ডুবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে বিলের তলায় অতিরিক্ত কাদায় মানুষ আটকে যায়। যার কারণে তীরবর্তী  গ্রামগুলোতে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। তাছাড়া মাত্র শুঁকিয়ে যাওয়া বিলের কিছু জায়গায় কাঁদা ছাড়া কোনো পানি না থাকলে সেখানে কেউ ঝাঁপ দিলে কাদায় গলা পর্যন্ত আটকে যেতে পাড়ে। তাকে কাদায় থেকে টেনে তোলা জন্য অন্য লোকের সাহায্য প্রয়োজন। 

সরেজমিনে পানিতে ডুবে তিনজনের মৃত্যু ঘটনা পৃথকভাবে জানা যায়। ইংরেজি ২০১৪ সাল। বাংলা শ্রাবণ মাসের ১৯ তারিখ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বিকালে  ভালকি বিলে নৌকা দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে তাসলিমা খাতুন (১৯) নামে এক গৃহবধুর মৃত্যু হয়েছিল। সে কোনাপাড়া গ্রামের আল-আমিনের স্ত্রী। আল-আমিন বলেন, বিল পার হওয়ার সময়ে নৌকা উল্টে পানিতে ডুবে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। কোনাপাড়া ও পাছারকান্দার মাঝে ভালকি বিল; ছোট নৌকায় চড়ে বিল পাড় হয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে বিলের মাঝখানে অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে নৌকা উল্টে পানিতে ডুবে ৭-৮ ফুট নীচে তার স্ত্রী তলিয়ে যায়। বিলের তলায় অতিরিক্ত কাদায় তার দেহ উল্টো দিকে মাথা আটকে গিয়ে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। সকল যাত্রী উদ্ধার করার পর তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রী নিখোঁজ। বিষয়টি টের পেয়ে উদ্ধারে নামেন স্থানীয় ডুবুরি ও অন্যান্য নৌকার মাঝিরা। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাসলিমা খাতুনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

পাচঁ বছর আগে বায়রাউড়া গ্রাম থেকে চারজন প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়া সকালে দুর্গাপূজা দেখতে পাছারকান্দা গ্রামে আসে। তারপর তারা শাপলা ফুল দেখার জন্য ভালকি বিলে চলে আসে।  তাদের মধ্যে তামান্না এবং ইতি আক্তার শাপলা তুলতে পানিতে নামে। কিছুক্ষণ পর ইতি পানির নীচের দিকে তলিয়ে যায় এবং তামান্না বিলের তলায় অতিরিক্ত কাদায় তার পা আটকে যায়। পরে তাদের চিৎকারে একজন বয়স্ক কৃষক উদ্ধারে নামেন। তামান্নাকে উদ্ধার করার পর ইতিকে উদ্ধারের জন্য তিনি ভয় পেয়ে যান। পরে গ্রামের লোকেরা এসে ইতি আক্তারকে উদ্ধার করেন মৃত অবস্থায়। 

ইতি আক্তারের মৃত্যুর বছরখানেক পর বায়রাউড়া গ্রামের ৫০ বছর বয়সী হেলিম মিয়া সেদিন ভোর বেলায় নিখোঁজ হন। নিখোঁজের সংবাদ শোনার পর আশপাশের গ্রাম থেকে ছুঁটে এসেছিল বিভিন্ন মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, এলাকায় সেতুর কাছে বিলের খাল পাড় থেকে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।  দিনভর চেষ্টার পর নিখোঁজের ১২ ঘন্টার পর হেলিম মিয়ার মরদেহ বিলের তলায় কাদা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটনে বিলের তলায় অতিরিক্ত কাঁদায় প্রাণহানির শিকার হয়েছেন তিনি।

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে এলাকাবাসীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে একবার যদি গেঁথে যায় যে বিলগুলো জাতীয় নদীর চিহ্ন, তখন তারা আরও সতর্ক থাকবে।

বর্তমান এই নদীর চিহ্ন হিসেবে গৌরীপুর হতে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত যতো খাল-বিল রয়েছে, পুরাতন নদীর ধারে যতো লোকজন রয়েছে তাদের মুখে রয়েছে অনেক ইতিহাস ও রূপকথার গল্প তা লিখে শেষ করা যাবে না। যেমন শাহগঞ্জের জল ভূরুঙ্গা একটি বিল ও মৌজা। জলসীমার কারণে এ মৌজার কোন বসতি নেই বলে জানিয়েছেন অচিন্তপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জায়েদুর রহমান। জল ভূরুঙ্গার রয়েছে এক রহস্যময় ইতিহাস। এক সময় এটি তলাবিহীন নদী নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান সমগ্র বিল কচুরিপানার ঢেকে আছে। এতে নদী ভরাটসহ মাছের অভয়াশ্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিল থেকে অতিরিক্ত কচুরিপানা অপসরণ করে বিলের পাড়ে পর্যটনের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা অতি প্রয়োজন।

পরিশেষে বলা যায়, বিলগুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, মাসের শেষ রবিবার আন্তর্জাতিক নদী দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিলগুলো ডেলটা প্ল্যানের আওতায় আনার জন্য আলোচনা করা হোক। বিল রক্ষণাবেক্ষণ ও খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হোক। বিষয়টি নিয়ে নদী ও বিলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মানুষের নানা সভ্যতা, সংস্কৃতি।

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী

এসবিডি/এবি/

মন্তব্য করুন: