• ঢাকা

  •  শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

সাহিত্য-সংস্কৃতি

ঈদুল ফিতর: ভাবনার নানা দিক

মোঃ সহীদুর রহমান

 প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩০ এপ্রিল ২০২২

ঈদুল ফিতর: ভাবনার নানা দিক

রমজান আরবি ‘রামাদান’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। রমজান মুসলমানদের পবিত্র  মাসগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  মাস। এ রমজানের  দিনগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে সেহেরি  ও ইফতার খেয়ে আল্লাহ্’র সন্তুষ্টির জন্যে দিনব্যাপী যে উপবাস বা সিয়াম পালন  করা হয়, তাই ইসলামে রোজা নামে পরিচিত। তাই টানা একমাস সিয়ামের পর  আল্লাহ্ তালাহ তাঁর বান্দাদের যে আনন্দদায়ক-সুসংবাদ দেন, সেটি (শাওয়াল চান্দের ১ তারিখ) ঈদুল ফিতর।

মুসলমানদের জন্য আরো ঈদ রয়েছে, তন্মধ্যে ঈদুল আযাহ, বড় ঈদ বা কোরবানির  ঈদ অন্যতম।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে  কোরবানির যে আত্মত্যাগ,-- তাঁরই স্মৃতিতে ভাস্বর কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আযাহা। আজকে মূলত ঈদুল ফিতরের প্রসঙ্গ টেনে খুবই সংক্ষিপ্তাকারে কিছু  আলোচনা করব।

প্রকতপক্ষে ঈদুল ফিতরকে নিয়ে রমজানুল মোবারকের মাসব্যাপী যে সিয়াম সাধনা, তা মূলতঃ প্রতিটি মুমিন মুসলমানের জন্যে বছরের বাকী এগারো মাসের একটি ট্রেনিং ওয়ার্ক। আসলে রমজান মাস হলো সৎপথে চলার দীপ্ত প্রত্যয়। রমজান মাস প্রত্যেক মুসলমানদের গুনাহ মাফের মাস। 

‘যে রমজান পেলো, অথচ তার গুনাহ খাতা মাফ করাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা আর কেউ নেই।’ হযরত জিবরিল আমিন নবী করিম (সাঃ) এর সামনে এসে এই রকম কথা বললে, নবী করিম (সাঃ) ‘আমিন’ বলে হযরত জিবরাইল (আঃ) কথার প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন দিলেন।

তাই বলা যায়, রমজানের ঈদ তাঁর জন্য, যে সত্য কথা বলে, মানুষের প্রতি সদাচরণসহ সৃষ্টি জগতের হক আদায় করে, তাঁরই জন্যে হলো ঈদ-উল-ফিতর।

হয়তো মুসলমানদের মধ্যে এমন দেখা যায়, সে হয়তো রোজা পালন করছে, কিন্তু সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, মিথ্যা বলা, পরনিন্দা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ-সহ এ জাতীয় সকল গুনাহ অথবা এর যে কোনো একটি গুনাহ করছে, তবে সে জেনে রাখুক,তার জন্যে রোজার উপবাস ফলপ্রসূ হবে না। কেননা, বেহালাল ভক্ষণ ও অশ্লীলতার কারণে তার ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য  নয়।

আর এটি স্পষ্ট, ইসলামে ঈমান ও নীতি - নৈতিকতার বিষয়ে কোনো আপোষ নাই। তাই যে নামধারী মুসলমান টুপি, দাড়ি, পাঞ্জাবি, জুব্বা পরিধান করলো, নামাজ-রোজা কঠোরভাবে পালন করলো অথচ সে আহার করলো সুদ-ঘুষের বা অবৈধ পথের রোজগারের টাকায়, এ বান্দা যতো ইবাদাতই করুক, আল্লাহ্ তা কবুল করবেন না।

সুদ পরিহার করতে এবং মানুষের উপর জুলুম না করতে আল্লাহ্ পাক নিষেধ করেছেন। তার পরও যারা সুদের লেনদেন বন্ধ করে না, তাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফের সুরা বাকারার ২৭৫ থেকে ২৭৯, সুরা রূম-এর ৩৯নং আয়াতগুলোতে কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

এ ছাড়াও সামাজিক জীবনেও ইসলামের অবস্থান  ইতিবাচক। এক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর হক আদায়ের  ওপর ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। শুধু নামাজ, রোজা, ঈদ উৎসব পালনের মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যে  মুসলমানরা ডুবে থাকলেই হবে না, অপরিহার্যভাবে যাবতীয় অন্যান্য হুকুমগুলোও প্রতিপালন করতে হবে। প্রতিবেশীর হক আদায়ে ইসলামের মানবিকতা এক যুগান্তকারী অধ্যায়। যা ইসলামকে করেছে মহিমান্বিত ও উজ্জীবিত। কিন্তু ক’জন মুসলমান আমরা তা পালন করছি? জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, হানাহানি প্রতিবেশির হক আদায়ের পথে অন্তরায়,-- যার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ঘোষণা আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) দিয়ে গেছেন।

নবী করিম (সাঃ)বলেন, ‘আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয় (তিন বার বলেছেন), যার প্রতিবেশী তার (মুসলমানের) হাত  ও জিহ্বা থেকে নিরাপদ নয়; -- যদিওবা সে অমুসলিম হয়।’

এখানে মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্যে অমুসলিম প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার রক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুসলিম প্রধান এ দেশে রমজান এলেই, ঈদ এলেই, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্য-পণ্যের দাম বাড়িয়ে  দেন, মজুদ করেন, কালোবাজারি করে সবার উপর জুলুম করেন; সেক্ষেত্রে মুসলমানদের অবশ্যই একটা দায় আছে, কেননা;  মুসলমান ব্যবসায়ীদের অসাধুতার কারণে যদি কোনো মানুষ কষ্ট পায়, (সে যে ধর্মেরই হোক); তার দায় ওই ব্যক্তিকেই নিতে  হবে। আর নবী করিম (সাঃ) তো বলেই দিয়েছেন, ওই রকম ব্যক্তি মুমিন  নয়।

তাছাড়া কোনো মূসলিম রাষ্ট্রে ভিন্ন ধর্মের কোনো মানুষ জুলুমের শিকার হলে, কাল-কেয়ামতের ময়দানে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বিধর্মীদের পক্ষাবলম্বন করবেন বলে মুসলমানদের হুশিয়ার করেছেন। দুনিয়ার জীবনে মদিনা রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে অমুসলিমদের জানমাল রক্ষায় সেই চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবায়ন করে নবী করিম (সাঃ) মানবতার অনন্য ইতিহাস গড়েছেন।

মানবতা, উদারতা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা; কিন্তু মুসলমানদের অনেকেই সে শিক্ষা থেকে যোজন যোজন দূরে। তবুও মূল ইসলামের অনুসারীরা, নবী (সাঃ) এঁর প্রকৃত আশেক, বিশেষ করে আউলিয়া কেরামগণ সেই চেতনাকে আজো ধারণ করে আছেন।

বলা বাহুল্য, ঈদুল ফিতরের রমজানের রোজা বা অন্য যে কোনো ইবাদত মুসলমানদের দেহ- আত্মার সাথেই সম্পৃক্ত। তাই কাজকর্মে, দেহে-মনে একনিষ্ঠভাবে সৎ থাকতে হবে।

ঈদুল ফিতর যেমন একদিকে মাহে রমজানের একমাস সিয়ামের শেষে আনন্দদায়ক সংবাদ দেয়, তেমনি মুসলিম উম্মাহকে সারাবছরের জন্যে সততা, ধৈর্য, ন্যায়নিষ্ঠভাবে পথ চলার প্রশিক্ষণও দেয়। তাই শুনতে অপ্রিয় হলেও একথা বলতে দ্বিধা নেই, পবিত্র ঈদের আনন্দ ও সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্যবান তাঁরাই, যাঁরা সত্য-সরল-সঠিক পথের পথিক।

আসলে ঈদ মানেই হাসি-খুশি আনন্দঘন উৎসব। ঈদ মানেই নতুন নতুন পোশাক, ভালো ভালো খাবারের পসরা। ঈদ মানেই  ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে নিয়ে একসাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়া। সত্য সুন্দরের পথে শত্রু-মিত্র সকলকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে, মহতী-ত্যাগের উৎসবের নাম-- ঈদ।

বাংলা সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রধানতম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ঈদুল ফিতরের সত্যিকারের  তাৎপর্য ও মহিমান্বিত রূপটাই ফুটে উঠেছে বিস্ময়করভাবে-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির  ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ। --- আজ ভুলে  যা তোর দোস্ত-দুশমন হাত মিলাও হাতে, --- তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামের মুরিদ।’ 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য করুন: