রিকশার প্যাডেলে ঘুরছে জীবন, শিক্ষক হতে চান শাহজালাল

ছবি- সংগৃহীত
অভাবের তাড়নায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন অন্যের বাড়িতে পেটে-ভাতে কাজ করতে দিয়ে দেন বাবা। পড়ার প্রতি আগ্রহ থাকায় বার্ষিক পরীক্ষার সময় মালিক পরীক্ষা দিতে না দেয়ায় কাজ ছেড়ে বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বসেন তিনি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য রিকশার প্যাডেলে পা রাখেন। সেই থেকে রিকশার প্যাডেলেই ঘুরছে তার জীবন। সংসারের খরচ যোগানোর পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। একজন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে আদর্শ শিক্ষক হতে চান ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মোঃ শাহজালাল (২৭)। এজন্য তিনি কামিলের পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির পড়াশোনাও করছেন। এই স্বপ্নবাজ তরুণের বাড়ি উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের বাঘবেড় গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত তারা মিয়া।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হন কিল্লা বোকাইনগর ফাজিল মাদ্রাসায়। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ২০১৬ সালে দাখিল, ২০১৯ সালে আলীম, ২০২৩ সালে ফাজিল পাস করে ঈশ্বরগঞ্জ ডি.এস মাদ্রাসায় কামিলে অধ্যয়ন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহজালাল পিতা-মাতার চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। ভাই-বোনের মধ্যে সেই পড়াশোনা করেছে। অন্য ভাইয়েরাও রিকশা চালিয়ে জীবন ধারণ করছেন। ২০২০ সালে বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পূর্বে ইচ্ছা পূরণ করতেই পাশ্ববর্তী অচিন্তপুর ইউনিয়নে বিয়ে করেন। এখন তার সংসারজুড়ে রয়েছে তিন বছরের ছেলে সন্তান মমিনুল হাসান সিয়াম। কামিল পরীক্ষার পাশাপাশি চাকরির পড়াশোনাও করছেন তিনি।
মোঃ শাহজালাল, “পরিবারের অভাব দূর করতেই ৭ বছর বয়সে রিকশার হাতল ধরি। রিকশা চালানো লজ্জার নয়। এটা পরিশ্রমের কাজ। রিকশার আয় দিয়েই সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়াশোনার খরচ যুগিয়ে চলছি। একদিন আমি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সামনে, বই হাতে নিয়ে দাঁড়াতে চাই, হতে চাই একজন আদর্শ শিক্ষক, এটাই আমার স্বপ্ন।”
তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও সমাজের গরিব শিশুদের জন্য কিছু করতে চান।
তিনি আরও বলেন, “যাদের টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি জানি গরিবের কষ্ট কী? তাই শিক্ষক হয়ে তাদের জন্য কিছু করতে পারলেই জীবন সার্থক হবে।”
তাঁর বড় ভাই আলামিন বলেন, শাহজালাল অনেক পরিশ্রম করে রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণ- পোষণ মেটানোর পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনা করেন। সে একজন শিক্ষক হয়ে সংসারের দারিদ্রতা ঘুচাতে চায়। সরকারের কাছে দাবি জানাই তাঁর ইচ্ছাপূরণের।
শাহজালালের স্ত্রী তাসলিমা জানান, একদম ভোরে উঠেই পড়াশোনা শুরু করেন। সকালের খাবার খেয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়ে যান। সারাদিন রিকশা চালিয়ে এসে রাতে আবার চাকরির বই নিয়ে পড়তে বসেন। শাহজালালের একটি চাকরি হলে তার পরিশ্রম স্বার্থক হবে।
প্রতিবেশিরা জানান, শাহজালাল নম্র, ভদ্র। সে কঠোর পরিশ্রম করে। ছেলেটির খুব ইচ্ছা একটা চাকরির। চাকরি পেলে তার পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরবে।
কিল্লা বোকাইনগর ফাজিল মাদ্রাসার সহকারি অধ্যাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর এই অবিচল মনোভাব অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। যেখানে অনেকেই হতাশায় ভেঙে পড়েন, সেখানে শাহজালাল জীবনসংগ্রামের মাঝেও স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছেন। তিনি প্রত্যাশা করে আরও বলেন, কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ই শাহজালালকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ বলেন, এমন অনেক শাহজালাল আছেন এই সমাজে—যাঁদের গল্প হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু তাঁদের অধ্যবসায় আর সংগ্রাম সত্যিই অসাধারণ। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের উৎসাহ দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। কারণ, এঁরাই একদিন দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবেন—শিক্ষক হয়ে, মানুষ গড়ে।
এসবিডি/ওবায়দুর রহমান
মন্তব্য করুন: