• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

অর্থ ও কৃষি

চলনবিলে মধু উৎপাদনে ব্যস্ত মৌয়ালরা

 প্রকাশিত: ০৮:০২, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

চলনবিলে মধু উৎপাদনে ব্যস্ত মৌয়ালরা

ছবি: সময়বিডি.কম

সিরাজগঞ্জ: চলনবিল অঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রূপ। শীতের সোনাঝরা রোদে ঝকমক করছে হলুদে-সবুজে মিশেল দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ক্ষেত। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে।

চলনবিলের তাড়াশ উপজেলার বিস্তৃর্ন মাঠে দেখা যায়, মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত পুরো বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পরপর মধু নিয়ে ফিরছে মৌয়ের বাক্সে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া যদি তেমন কোনো বৈরী আচরণ না করে তাহলে চলনবিল অঞ্চলে ১ হাজার ২০০ টন মধু আহরণ করা সম্ভব হবে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন্ন ২৫০ টাকা হিসেবে ৪৩ কোটি থেকে ৪৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা।

সাতক্ষিরা থেকে আসা মৌচাষি আব্দুল কাদের জানান, প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সাড়ে সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌ-খামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। তারা সরিষা ক্ষেতের আইলে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ মৌয়ের বাক্স বসিয়েছেন। 

তিনি বলেন, প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।

জানা যায়, চলতি মৌসুমে চলনবিলে ৯টি উপজেলায় প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবি জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে। সরিষা ক্ষেতে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিদের। পুরো চলনবিল অঞ্চল মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মৌচাষিরা মধু আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলতি মৌসুমে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টন সরিষা ও ১ হাজার ২০০ টন মধু উৎপাদনের দিকে এগিয়ে চলছে চলনবিল।

এ অঞ্চলে উৎপাদিত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো হওয়ায় ভারতের ডাবর কোম্পানি এবং বাংলাদেশের প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামী-দামি কোম্পানির অ্যাজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছেন।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সময়বিডি.কমকে জানান, চলতি বছরে তাড়াশ উপজেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় ৫৫ জন মৌচাষি এসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য। মৌচাষিরা ৬হাজার ৬৮১টি মৌবাক্স দিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন।

কৃষক আব্দুল জলিল জানান, এক একর জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘায় ছয় থেকে সাত মণ সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মণ সরিষার বাজারমূল্য ২ হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে একই পরিমাণ জমিতে সরিষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। 

এ অঞ্চলে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মৌসুমি মৌ-চাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ ছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকরা এখন ধান ও অন্য ফসলের পাশাপাশি সরিষে চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন।

চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল গ্রামে কৃষক জাকির হোসেন জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুণ মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন না, মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষার ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।

শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু অগ্রিম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো হওয়ায় ভারতের ডাবর কোম্পানি এবং বাংলাদেশের প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামী-দামি কোম্পানির অ্যাজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছেন। সুন্দরবনের মধুচাষিরাও এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এখানে পুরোদমে শুরু হয়েছে মধু সংগ্রহ।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে অতীতকাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুদ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এ ছাড়া মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য।

ডিসেম্বর ২১, ২০২২

মন্তব্য করুন: