• ঢাকা

  •  বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

অর্থ ও কৃষি

জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ খেজুর গুড়ের হাট

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি:

 আপডেট: ১৭:৫২, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ খেজুর গুড়ের হাট

ছবি: সময়বিডি.কম

চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট। সরোজগঞ্জ বাজার থেকে একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। 

প্রতিবছরের মতো এবারও দেশের বৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট জমে উঠেছে সরোজগঞ্জে। গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন ব্যাপারিরা। সপ্তাহে দু'দিন শুক্রবার ও সোমবার বসে এই হাট। খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য দুইশ' বছরের।

চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এই হাটটির অবস্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। প্রতি সপ্তাহে প্রায় কয়েক কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়।

মাটির হাড়ি বা ভাঁড়ের আকার ও ওজনভেদে দাম ওঠানামা করে। মানভেদে একভাঁড় গুড় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এখানকার খেজুর গুড়ের চাহিদা এবার বেশি থাকায় দামও কিছুটা বেড়েছে।

হাটে গিয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, পুরো এলাকাজুড়ে সাজানো খেজুর গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড় ও ছোট ছোট ধামা-কাঠায় নলেন পাটালি। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ভর্তি করা হচ্ছে ট্রাক। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিনছেন। 

হাটের প্রবেশপথের দু’ধারে বসে কৃষকেরা ধামা-কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করছেন। পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যত যাওয়া যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। হাটের একাধিক স্থানে দাঁড়িপাল্লায় গুড় মেপে হাটে ভেড়ানো ট্রাকগুলোতে গুড়ের ভাঁড় তুলে সাজানো হয়। আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত চলবে বেচাকেনা।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এই হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুড় কিনতে সরোজগঞ্জের হাটে আসেন ব্যাপারীরা। ঢাকা থেকে গুড় কিনতে এসেছেন লিয়াকত আলী। তিনি সময়বিডি.কম-কে জানান, দেশের অন্যান্য হাটে এখানকার চেয়ে কম দামে গুড় পাওয়া যায়। তবে, সেসব গুড়ে চিনি মেশানো থাকে বলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কেউ তা কেনেন না। বেশি দাম জেনেও ব্যাপারীরা ভালো গুড় কিনতে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের এই হাটে ছুটে আসেন। ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের একটি গুড়ের ভাঁড় ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এহাটে নিরাপত্তা সহকারে আমরা গুড় কিনতে পারি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের গুড়ের ক্রেতা আলী হিম সময়বিডি.কম-কে জানান, আমরা এই সরোজগঞ্জ বাজার থেকে বহুদিন ধরে গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকি। বিশেষ করে ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ফরিদপুর, টেকের হাটসহ বিদেশেও রপ্তানি করে থাকি। তবে এবার গুড়ের বাজার ভালো। 

তিনি আরো জানান, বর্তমানে গাছি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। কেননা, পুরাতন গাছি যারা তারা অনেকেই মারা গেছেন। যুবক ছেলেরা কেউ নতুন গাছি হচ্ছে না। তাই গাছি কমে গেছে সে ক্ষেত্রে বাজারে গুড় কম আসতে শুরু করেছে। এবাজার থেকে প্রতি হাটে ২০ থেকে ২৫ টি ট্রাক লোড হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়।

সরোজগঞ্জ গুড়ের হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীননগর গ্রামের গাছি কাদিমুল ইসলাম জানান, আমি প্রায় ৪০টি গাছের রস সংগ্রহ করি। প্রায় ২০ বছর ধরে এই হাটে গুড় নিয়ে আসছি। আমাদের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা গুড় কিনে নিয়ে যায়। তবে, গুড়ের ভাড়ের দাম বেড়েছে। এ কারণে এখন কম লাভ হয়।

সরোজগঞ্জ গুড়ের হাটের শ্রমিকের সর্দ্দার খাইবার আলী বলেন, আমরা ব্যাপারীদের গুড় টানার কাজ করি ও ট্রাকে গুড় লোড করি। সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতি হাটে আয় হয় ৭০০-৮০০ টাকার মতো। এ কাজ করে সংসার ভালোই চলছে।

সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাটের বাজার কমিটির সভাপতি আলী আহাম্মদ হাসানুজ্জামান সময়বিডি.কম-কে জানান, সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় সরোজগঞ্জ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীদেরকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত মৌসুমের তুলনায় চলিত মৌসুমে জেলার ৪ উপজেলায় ১৬ হাজার নতুন খেজুর গাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করছেন। এবারের মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৪৮ হাজারের মতো খেজুরগাছ থেকে কৃষকরা রস আহরণ (সংগ্রহ) করছে। যার প্রায় অর্ধেকই চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায়। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে গুড়ের মৌসুম। এই মৌসুমে গড়ে আড়াই হাজার মেট্রিকটন গুড় উৎপাদিত হবে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা সময়বিডি.কম-কে বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৬০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৯৩ হাজার ৪৫০টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ৮৩ হাজার ৭০০টি, জীবননগর উপজেলায় ৩৬ হাজার ৫০০টি এবং আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩৫ হাজার ৩১০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এই গাছগুলো থেকে চলতি বছর ২ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জানুয়ারি ২৪, ২০২৩

সালাউদ্দীন কাজল/এডিবি/

মন্তব্য করুন: