• ঢাকা

  •  শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

মত-অমত

বিশ্ব নদী দিবসে বিশেষ নিবন্ধ / শাফায়াত স্বচ্ছ

 আপডেট: ১৮:১৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিশ্ব নদী দিবসে বিশেষ নিবন্ধ / শাফায়াত স্বচ্ছ

সুন্দরীতমা আমার

নদীময়, স্রোতধাত্রী এই দেশ। বাংলাদেশের প্রধান পরিচয়, প্রতীক ও অস্তিত্ব এই নদী। আর পাঁচটি ভূখন্ডের কাছে নদী যেমন একটি প্রাকৃতিক উপাদানমাত্র, বাংলাদেশের কাছে তেমনটি নয়। এ দেশের মাতৃকাসম এই নদীগুলো, এ জলধারাগুলোই সঞ্চয় করে আমাদের সহস্রাব্দের আবহমান ঐতিহ্য, লালিত সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার সম্ভার।

একেকটি নদী শোনায় একেক জনপদের বিচিত্র গল্প, জমিয়ে রাখে মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখের গাথা ৷ বয়ে চলে ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে। কখনো উজাড় করে দান করে, কখনো বা নিঃস্ব করে দেয় একেবারে। তবু তার সাথে এই বনিবনার সম্পর্ক বয়ে চলে যুগের পর যুগ। নদী তাই বাংলার মানুষের কাছে স্রষ্টার এক অনন্য আশীর্বাদ। কিন্তু, কদর করতে না জানলে সে আশীর্বাদের দশা কেমন হতে পারে? 

আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর, পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। মৃত্যুশয্যায় পতিত রোগীকে শুভেচ্ছা জানানো যেমন নিরর্থক, বাংলাদেশকে এ দিবসটির শুভেচ্ছাবার্তা জানানোও অনেকটা তাই। কারণ, বাংলাদেশের মাতৃসম একটি নদীও ভালো নেই, অন্তত একটি নদী সম্পর্কেও হলপ করে বলা যাচ্ছে না যে, নদীটির সঠিক পরিচর্যা হচ্ছে। বরং ক্রমাগত নির্যাতনে একেকটি নদী পতিত হয়েছে মৃত্যুমুখে। মানচিত্রে হারিয়ে গেছে কয়েকশ’ নদী, আয়োজন হয়েছে আরো কয়েকশ’র৷ যেগুলো বেঁচে-বর্তে আছে, তারাও ধুঁকে ধুঁকে নিশ্বাস ছাড়ছে। প্রধান তিন জলাঙ্গী পদ্মা, মেঘনা,যমুনা নাব্য সংকটে পতিত দশক ধরে। এককালে প্রথম সারিতে থাকা ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, আত্রাই, করতোয়া, সুরমার মতো নদ-নদীগুলোরও দৈন্যদশা ৷ রাজধানীর ফুসফুস বুড়িগঙ্গা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ বড়ো হচ্ছে। দূষণে-দখলে শহুরে নদী বিপন্নপ্রায়। জেলেদের পেশা বদলাচ্ছে, জলজীবের সংখ্যা কমছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, প্রতিকারে কতটুকু আন্তরিক রাষ্ট্র? 

বাংলাদেশে নদ-নদীর মোট সংখ্যা কতো, এই প্রশ্নেই বিভ্রান্ত সরকারি দপ্তরগুলো। লোকগাথায় বলে, তেরোশত নদী। সাহিত্যেও তাই৷ পাউবো ২০০৫ সালে তাদের নদী বিষয়ক গ্রন্থে এ সংখ্যা উল্লেখ করে ৩১০। ২০১১ সালে সংশোধিত পুস্তকে তা ৪০৫ বলা হয়। এই নিয়ে সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো আবার ভিন্নধারার গবেষক। তারা ৭০০-২০০০ পর্যন্ত উল্লেখ করেছে। আর নদী রক্ষায় কাজ করার দায়িত্ব যে নদীরক্ষা কমিশনের, তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই। রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ড. তুহিন ওয়াদুদের মতে, এ সংখ্যা ২০০০ এর কম হবেনা।  

২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত দেশের সমস্ত নদ-নদীকে 'জীবন্ত সত্তা' ঘোষণা করে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে কাজ করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়,পানি উন্নয়ন বোর্ড, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও একাধিক সরকারি বিভাগ। নদী নিয়ে এতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বোধহয় আর কোনো দেশেই নেই। অথচ সুফল যা মিলছে, অঙ্কে তা সামান্যই।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘ডেলটা প্ল্যান ২১০০’ এর অংশ হিসেবে দেশব্যাপী ২০১৯ সাল নাগাদ শুরু হয় ঢালাওভাবে নদী খনন৷ সরেজমিনে দেখা যাচ্ছে, নদীর প্রস্থ কমানো, তীর দখল, অর্থলোপাট, বৈজ্ঞানিকভাবে খনন না করা ইত্যাদি পুরোনো অভিযোগ আছে প্রতিটি প্রকল্পে। উত্তরের খনন করা অধিকাংশ নদী এক বছরের মাথায় পুরোনো দশায় ফিরে গেছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২২ এর শুরুতে এ খনন করা আত্রাইয়ের বালু এখন আবারো ভারি বর্ষণে নদীতে চলে গেছে৷ পূণর্ভবা, ঢেপা, টাঙ্গন, কুলিখ, করতোয়ারও একই দশা। উপরন্তু বেড়ে চলছে নদীখেকোদের সংখ্যা। বাড়ছে নদী দূষণ। ভারতের বাঁধের কবলে পড়ে উত্তরাঞ্চলের মেরুকরণ শুরু হয়েছে প্রায় দুই দশক আগেই।

এতোকিছুর মধ্যেও সুসংবাদ যে নেই, তা নয়। দেরিতে হলেও নদীরক্ষায় সরকারের সদিচ্ছা দৃশ্যমান। বর্তমানে ১৭৮টি নদীর খনন চলমান। বুড়িগঙ্গা-তুরাগতীরে যেভাবে দখলমুক্তি অভিযান করা হয়েছে, যেভাবে ৯০০ কিলোমিটার নদীপথ খননের মহাযজ্ঞ চলছে, তা সত্যিই আশাজাগানিয়া। তিস্তা নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় হাঁটার কথা ভাবছে বাংলাদেশ। বুড়িগঙ্গাকেও পরিচর্যায় আনা হচ্ছে৷ নদী নিয়ে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে মানুষের সচেতনতা এখন বেশি। বেলা, নোঙর, নদীযাত্রিক, রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু সংগঠন সক্রিয় আন্দোলন করছে নদীরক্ষায় ৷ অতি সম্প্রতি তরুণ প্রজন্মের ক'জন কন্ঠশিল্পীর নদী সচেতনতা সৃষ্টিতে গঠন করেছেন দেশের প্রথম নদীভিত্তিক অভিনব ব্যান্ড ‘নদীরক্স’। তাঁদের মুখ্য গানটি অনেকটা এমন-

‘নদীর কাছে যাই, চলো নদীর কাছে যাই,
সুন্দরীতমা নদী আমার বেঁচে থাকা চাই।’

তরুণ প্রজন্মের এ আবেদন সত্যিই আমাদের আপ্লুত করে, আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায়। আমাদের নদী নিয়ে আমাদেরই এগিয়ে আসার পালা এবার। পরিকল্পনা অনেক হয়েছে, আলোচনা হয়েছে অনেক৷ এখন সময় এগুলোকে একটু একটু করে ফলিত করার৷  

পরবর্তী নদী দিবসটিতে আমরা আমাদের সুন্দরীতমাদের এই বিপন্নদশা আর দেখতে চাই না। রএদের বেঁচে ওঠার মধ্যদিয়েই নতুন করে বাঁচার রসদ পাবে আগামীর বাংলাদেশ।  

শাফায়াত স্বচ্ছ, শিক্ষার্থী

সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২

এসবিডি/এবি/

মন্তব্য করুন: